বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ও ঘটনাপ্রবাহ

তানভীর আলম চৌধুরী | ১৭ মে ২০২৩, ০৫:১২

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান, কার্যক্রম সহ রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহারের কিছু ঘটনাপ্রবাহ এই লেখার মধ্যে আমরা দেখতে পাবো। আসুন আফগান জিহাদ থেকে ঘটনাপ্রবাহে কিভাবে এবং কাদের মদদে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান একটু দেখি। আর বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মুফতিদের কারা প্রথম প্রজন্মের জঙ্গী সংগঠক সেটাও দেখতে পাবেন। এবং বিএনপির শীর্ষ নেতারা কিভাবে জঙ্গীদের ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে তাও উল্লেখ্য।

পিডিপিএ বা পিপলস্ ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান ছিল বামপন্থী নিষিদ্ধ সংগঠন। ১৯৭৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিডিপিএ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং নুর মোহাম্মদ তারাকী রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ক্ষমতায় আসার পর পিডিপিএ সরকার ২৭০০০ রাজনৈতিক বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে কিন্তু আফগান জনগণের তা পছন্দ হয় নি তাই তারা বিদ্রোহ করে। ১৯৭৯ সালে হাফিজুল্লাহ আমিনের সমর্থকরা বিল্পব করে আমিনকে ক্ষমতায় আনে। এদিকে পিডিপিএ এর ক্ষমতা স্থায়ী করতে এবং পিডিপিএ সরকারকে সাহায্য করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর একটি সামরিক বিল্পবের নাটক সাজিয়ে হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করে এবং সোভিয়েতপন্থী বারবাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়।

১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আফগানিস্তান থেকে "সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি এবং নি:শর্ত প্রত্যাহারের" দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করে, অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪–১৮ ভোটে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার না করার কারণে মার্কিন ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদে বিভিন্ন দেশ থেকে মুজাহিদীন রিক্রুট করা হয়। আমাদের বাংলাদেশে তো জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের সামনে ব্যানার ঝুলিয়ে মুজাহিদীন সংগ্রহ করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আফগান জিহাদকে সমর্থন করে।

ভারতের দেওবন্দ শিক্ষায় শিক্ষিত তথা কওমীর হুজুররা ছিল আফগান জিহাদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী। আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশের ৩ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশী কমান্ডার আব্দুর রহমান ফারুকী ছাড়াও নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মঞ্জুর হাসান, মুফতি আব্দুল হাই, কমান্ডার মঞ্জুর আহম্মদ এবং মুফতী শহীদুল ইসলাম যিনি চারদলীয় জোটের সাবেক এমপি। চাপের মুখে পড়ে মিখাইল গর্বাচেভের সোভিয়েত সরকার যখন ১৯৮৯ সালে পুরোপুরি সৈন্য প্রত্যাহার করে ততদিনে পাকিস্তান ও মার্কিন মদদপুষ্ট মুজাহিদীনরা শক্তি সঞ্চয় করে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে মাদ্রাসা ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে তালেবানী বাহিনী যা একের পর এক শহর দখল করতে থাকে এবং সোভিয়েত সৈন্যদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ করতে থাকে। উল্লেখ্য যে মার্কিন ট্রেনিং প্রাপ্ত মুজাহিদীনদের মধ্যে পরবর্তীকালের দুর্ধর্ষ জঙ্গীনেতা ওসামা বিন লাদেনও ছিল। আফগান ফেরত যোদ্ধারা একদিকে যেমন পেয়েছিল দুর্ধর্ষ ট্রেনিং তেমন পেয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের মত জঙ্গীনেতার সহচার্য।

হরকাত আল জিহাদ আল ইসলামীর উচ্চ পর্যায়ের নেতা কমান্ডার সাইফুল্লাহ আখতার যিনি একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেন কওমী আলেম সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে। হরকাত নেতা সাইফুল্লাহ যখন ১৯৮৮ সালের জানুয়ারীতে বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তার সঙ্গে আরও দুইজন আন্তর্জাতিক মানের উগ্রপন্থী কমান্ডার হরকাত নেতা এসেছিলো। তাদের একজন হলো কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, এক সময়ের কাতার সরকারের শরীয়ত বিষয়ক উপদেষ্টা শায়খ আব্দুল মুইজ আব্দুস সাত্তার মিসরী যিনি হরকাতুল জিহাদ প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্বব্যাপী তহবিল সংগ্রহ করেন। এবং অন্যজন হলেন ফিলিস্তিনের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকতা শায়খ তামীম আল আদনী। প্রথমবারের মত হরকাতের তিনজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা যখন বাংলাদেশে আসে তখন তাদের মেহমানদারি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল কওমী মাদ্রাসার আলেম সম্প্রদায়। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসায় গিয়ে জিহাদের বাণী প্রচার করে এবং পরে জঙ্গী তৈরীর কারখানা চট্টগ্রামের হাটহাজারী আহলিয়া দারুল উলূম-মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় যান। একদিকে জিহাদের ছবক আর অন্যদিকে আরব দেশের অঢেল টাকা কওমী হুজুরদের হরকাতুল জিহাদের দিকে নিয়ে আসে। তারপর তারা চট্টগ্রামের লালখান বাজারের জামেউল উলুম মাদ্রাসায় গিয়ে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করেন যিনি আবার ওসামা বিন লাদেনের শিষ্য এবং বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান।

এছাড়া ১৯৮৮ সালের ২ মার্চ কওমী মাদ্রাসার বড় বড় দশজন জঙ্গী সংগঠকের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান যায়। তারা হলেন শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, চট্টগ্রামের মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতান যওক নদভী। সিলেট থেকে মুফতি হাবিবুর রহমান। কিশোরগঞ্জ থেকে মাওলানা আতাউর রহমান খান। বিশিষ্ট ওয়ায়েজ হাবিবুল্লাহ মিসবাহ, মাওলানা আব্দুল মান্নান ফরীদপুরী। প্রতিনিধি দলের অন্য তিনজন সদস্য অন্যান্য জেলার কওমী আলেম। প্রতিনিধি দল প্রথমে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী করাচীস্থ দফতরে যান এবং বিভিন্ন হরকাত নেতা, কমান্ডারদের সাথে সাক্ষাত করেন। ১০ মার্চ তারা আফগানিস্তান সফরে গিয়েছিলো এবং ওসামা বিন লাদেন সহ বিভিন্ন আফগান হরকাত নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মানের কিছু জঙ্গী নেতা একাধিকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - পাকিস্তানের মাওলানা ইউসুফ বিন নূরী, তাহফুজে খতমে নবুয়াত নেতা মাওলানা মঞ্জুর আহেমদ চিউনিটি, হামাশের নেতা আহম্মদ শাহ, ওসামা বিন লাদেনের শিষ্য, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নেতা, আরকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্টির চেয়ারম্যান এবং বিশ্ব মুসলিম সংস্থার উপদেষ্টা ড. নূরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইউনুস ও মাওলানা ফজলুুর রহমান।

১৯৯২ সালের ৩০ শে এপ্রিল ওসামা বিন লাদেনের সহযোগী যোদ্ধা বাংলাদেশী নাগরিক শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদের নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদ ইসলামী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠান হয়। হরকাতুল জিহাদ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন আফগান ফেরত মুজাহিদীনরা। তাদের প্রথম আক্রমণ ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা। ২০০১ সালের ১৪ ই এপ্রিল রমনার বটমূলে বোমা হামলা। ২০০১ সালে ৩ জুুন গোপালগঞ্জের গীর্জায় বোমা হামলা। ২০০১ সালের ১৬ ই জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা। ২০০৪ সালের ২১ শে মে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা। ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট ঢাকায় শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশকে প্রথম প্রজন্মের জঙ্গী সংগঠন মনে করা হয়।

১৯৯৮ সালে তালেবান থাকাকালীন মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী আফগান সফরকালে উসামা বিন লাদেনের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করলে বাংলাদেশে জিহাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আলেম উলামাদের প্রতি আহ্বান জানান।

আরকান জিহাদ ও বাংলাদেশঃ

হরকাতুল জিহাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম কারণ ছিল আরকান জিহাদ। সেই আরাকান জিহাদের নাম ভাঙিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক টাকা বাংলাদেশে আসে অনুদানের নামে। আরাকান জিহাদে যাওয়ায় জন্য রওনা দেয় একদল হরকাতুল জিহাদের সদস্য যারা কওমী মদ্রাসার শিক্ষার্থী। নাফ নদী পার হয়ে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের ক্যাডাররা বার্মার একটি কওমী মাদ্রাসায় উঠে এবং সেখানে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO) ও এর ছাত্রসংগঠন ইত্তেহাদুল তোল্লাবুল মুসলেমিন এর সদস্যরা তাদের সাথে যোগ দেয়। ১৯৮৪ সালের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির আর্থিকভাবে সহযোগিতা, জিহাদি প্রশিক্ষণ, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, এদেশে পুনর্বাসন এবং দেশ-বিদেশ থেকে আরাকান জিহাদের নামে অর্থের যোগান দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা আরাকান পুনরুদ্ধার এবং বার্মার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার সময় বাংলাদেশে ও বার্মার আরাকানে প্রতিষ্ঠা হয় জঙ্গী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO)। উক্ত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমীর করা হয় ডা. মোহাম্মদ ইউনুসকে। RSO এবং তার ছাত্র সংগঠনের ১০ হাজার কর্মী সদস্য ও মুজাহিদদেরকে ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে বান্দরবানের গহীন অরণ্যে বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন অরণ্যে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তৎকালীন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলো সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলো আমিনুল ইসলাম মুকুল। ওদের দুজনের তদারকিতে 'ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ফাইন্যান্স এন্ড সোশ্যাল অর্গানাইজেশন' ও 'রাবেতা আল ইসলামীর' আর্থিক সহযোগিতায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। RSO এর সশস্ত্র বিপ্লবীদের অত্যাধুনিক সকল অস্ত্রের জোগান দিতো ইসলামী ছাত্র শিবির কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে দেওয়া হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের সনদ আর সেসব ছবি RSO এবং আইটিএম এর বিভিন্ন মাসিক মুখপত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ থেকে আরাকানে জিহাদের নামে জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতারা আর্থিক অনুদান নিয়ে আসতো। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির শুধু রোহিঙ্গা জঙ্গীদেরকে দেশের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা করে তা নয় এমনকি লিবিয়া, মিশর ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে ওদের খরচে পাঠানো হয় জঙ্গীদেরকে। আরএসও এর কমান্ডারগণ, ছাত্র সংগঠন আইটিএম এর ট্রেনিং প্রাপ্ত ক্যাডার, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের সদস্যদের চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্র শিবির ও ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষা সফর ও উচ্চ শিক্ষার নামে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করে দেয়।

যেসব কওমী মাদ্রাসায় তৎকালীন হরকাতুল জিহাদের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতো সেবব কওমী মাদ্রাসা হলো - চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসা, একই থানার অন্তর্গত আল-জামেয়াতুল আরবিয়া জিরি মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজারস্থ জামেউল উলুম লালখান বাজার মাদ্রাসা, হাটহাজারী থানার অন্তর্গত আল-জামেয়া আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, একই থানার অন্তর্গত আল জামেয়া ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম চারিয়া মাদ্রাসা, নাজিরহাট সদরে অবস্থিত নসিরুল উলুম প্রকাশ নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা, ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত আল জামেয়া ওবাইদিয়া নানপুর মাদ্রাসা, ফটিকছড়ি সদরে অবস্থিত বিবির হাট তালিমুদ্দীন মাদ্রাসা, রাঙ্গুনিয়া সফরবাটা মাদ্রাসা, বোয়ালখালী ওয়াহেদিয়া মাদ্রাসা, ঢাকা লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়া মাদ্রাসা, বগুড়া জামিল মাদ্রাসা, বি-বাড়িয়া বড় হুজুরের মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ জামেয়া আরবিয়া সহ অহরহ মাদ্রাসায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবানের গহীন অরণ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প এর পশ্চিমের গহীন দূর্গম সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের সকল ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে RSO কমান্ডার নাজমুল্লাহ ও কমান্ডার নুরুল ইসলাম। কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার ইউনানী সৈকত, রাজা পালং, রামুর গহীন জঙ্গলে, টেকনাফ সীমান্তের আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায়, চট্টগ্রামের পটিয়া থানার পাহাড়ি এলাকায়, দোহাজারী রেল লাইনের সোজা পূর্বদিকে পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গীদের হরদম প্রশিক্ষণ চলতো।

আমাদের দেশে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক কিছু এনজিও ইসলামী রাজনীতির নামে জঙ্গীবাদের মাধ্যমে এদেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানাতে অঢেল অর্থ সহায়তা প্রদান করে। ঐসব এনজিওর মধ্যে সবচেয়ে বেশী অর্থ জোগান দিয়েছিল - ১/রিভাইভাল আল-হারামাইন হেরিটেজ, ২/কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি ৩/রাবেতা আল ইসলামী, ৪/মুসলিম এইডইউকে, ৫/ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড সোশ্যাল অর্গানাইজেশন, ৬/ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন, ৭/কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ সোসাইটি। এসব দাতা সংস্থাসমূহ সকল অনুদানের জন্য আর্থিক লেনদেন করতো বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকে এবং তা একমাত্র সকল জঙ্গী সংগঠনের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো। বাংলাদেশ হরকাতুল জিহাদের প্রথম সাড়া জাগানো বহুল প্রচারিত ও পঠিত মাসিক মুখপাত্র ছিল "মাসিক জাগো মুজাহিদ" এবং যার মাধ্যমে সমাজের তরুণদের সশস্ত্র জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হতো। হরকাতুল জিহাদ প্রকাশ্যে আর্থিক লেনদেনের ঘোষণা দিতো এবং তাদের হিসাব বিবরণ ছিল -

মাসিক জাগো মুজাহিদ
চলতি হিসাব নং - ৫৩১৯
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
লোকাল ব্রাঞ্চ, মতিঝিল, ঢাকা।

তাছাড়া প্রত্যেক মাসে বিজ্ঞাপন দিয়ে মাসিক জাগো মুজাহিদ সাময়িকীতে হরকাতুল জিহাদ কে এই ব্যাংক আর্থিক সাহায্য করতো। কেবল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ নয় বার্মার হরকাতুল জিহাদ আরাকান শাখার সকল লেনদেনও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে করা হতো। হরকাতুল জিহাদ ইসলামী আরকান শাখার প্রতিষ্ঠাতা আমীর কমান্ডার মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসের নামে হিসেব খুলে আরাকান জিহাদের নামে আর্থিক লেনদেন করতো। নিম্নে হিসেবের বিবরণ দেওয়া হলো -

আব্দুল কুদ্দুস
চলতি হিসেব নং - ২৮৫৩৫
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
৭৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০।

আরকানে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO) নামের জঙ্গী সংগঠনের সকল আর্থিক লেনদেনও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে হতো। RSO এর প্রতিষ্ঠাতা আমীর ডাঃ মোহাম্মদ ইউনুস। নিম্নে তার ব্যাংক হিসেবের বিবরণ দেওয়া হলো -

ডাঃ মোহাম্মদ ইউনুস
চলতি হিসেব নং - ৪২৯৭
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
আগ্রাবাদ শাখা, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক স্বার্থে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীকে খুশী করতে ১৯৭৯ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। হরকাতুল জিহাদ যখন দেশে শক্তি সঞ্চয় করে মুজাহিদীনের সংখ্যা বাড়াচ্ছিল তখন হরকাতুল জিহাদের আমীর মুফতি হান্নানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বিএনপি সরকারের ক্ষমতার সর্বস্ব তারেক রহমান। তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুল সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দীনকে একটি প্রস্তাব দেয় মুফতি হান্নান। সে প্রস্তাব ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা যা ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট বাস্তবায়িত করে তারা।মাওলানা তাজউদ্দীন এবং মুফতি হান্নান পরস্পরের সাথে পরিচিত ছিল। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার সাত মসজিদে তাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়।সে বৈঠকে তারা তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জামান বাবরের সাথে দেখা করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। মাওলানা তাজউদ্দীন তাকে (মুফতি হান্নান) আব্দুস সালাম পিন্টুর কাছে নিয়ে যায়। আব্দুস সালাম পিন্টু লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে যায়। তখন লুৎফুজ্জামান বাবর এবং কায়কোবাদ মিলে হাওয়া ভবনে আসে"মি: কায়কোবাদ তখন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। হাওয়া ভবনের বৈঠকে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআই-এর তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুর রহিম উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতির কিছুক্ষণ পর তারেক রহমান সেখানে আসেন। এমনটাই জানা যাচ্ছে আদালতে দেয়া মুফতি হান্নানের জবানবন্দি থেকে মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগীরা যাতে হাওয়া ভবনে আর না আসে সেটি জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, " আপনারা বাবর সাহেব এবং আব্দুস সালাম পিন্টুর সাথে যোগাযোগ করে কাজ করবেন।" পাকিস্তানী নাগরিক মাজেদ ভাট এবং মাওলানা তাজউদ্দীন পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড এনে মুফতি হান্নানকে দিয়েছিল। আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে সে গ্রেনেডগুলো বিতরণ করা হয় বলে মামলা নথিপত্রে উল্লেখ আছে। ঘটনার পর মাওলানা তাজউদ্দীনকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে পাসপোর্টে তার নাম দেয়া হয়েছিল বাদল। এ কাজের সাথে তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা এটিএম আমিন এবং সাইফুল ইসলাম ডিউক জড়িত ছিল।মুফতি হান্নানসহ মোট ১৮জন আসামী এ মামলায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পরবর্তীতে ২২৫ সাক্ষী আদালতে এসেছে।

রেফারেন্সঃ
একজন জঙ্গীর আত্মকথা - হাসান রফিক।
মুফতি হান্নানের জবানবন্দি - ২০০৪ গ্রেনেড হামলা মামালা।

লেখক,
শিক্ষার্থী,
অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: