কাঁচের সামনের অংশ যতটুকু মসৃণ পেছনের অংশ ততটুকু অমৃসণ

ইমরুল কবির | ৩১ জুলাই ২০২২, ১০:৪১

ছবিঃ সংগৃহীত

অনেক ভাবনার পর লেখাটি লেখতে মনোনিবেশ করলাম, গল্প দিয়ে শুরু করা যায় আজকের লেখাটি। সৈয়দ মুজতবা আলীর বয়স যখন ২৭, তখন 'নেড়ে' শীর্ষক তার গল্পটি ছাপা হয়, গল্পটি হলো-আবদুল রসুল নামক এক যুবক পূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চল থেকে কলকাতা সরাসরি দৌড়ে স্টিমারে এসে কোনোমতে দোতলা সিঁড়ির কাছে একটি আসন পেতে বসে। এই সময়ে দেখতে পেল এক পৌঢ় হিন্দু দম্পতি স্টিমারের উপরে উঠে আসছেন। স্টিমারের দোতলাতে ওঠার পর তাঁদের খেয়াল হলো যে তাঁদের কুলি ও মুল্যবান গহনার বাক্সসহ তাঁদের মাল আসেনি। রসুল সাহেব পরিবারটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তিনি জাহাজ থেকে নেমে হারানো মাল উদ্ধার করে নিজের কাঁধে বয়ে জাহাজে তুলে আনলেন। তাঁর দখল করা স্থান তাদের জন্য ছেড়ে দিলেন।

এদিকে পৌঢ় ভদ্রলোকটি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত ব্যক্ত করে চললেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন আমি ছোঁয়াছুঁয়ি মানি নে। ওতে তো আর কোন খরচ নেই। কেনই বা মানব? কেন মুচি মুসলমান কি মানুষ নয়? ওদের সঙ্গে বসে কেন খাব না? খুব খাব-আলবৎ খাব। এর মধ্যে দম্পতিটি জলখাবার বের করলেন। আবদুল রসুল সেখান থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ভদ্রলোক তাকে ছাড়লেন না। 'খান' বলে টব করে একটি রসগোল্লা জোর করে তাকে খেয়ে দিলেন। ঘন্টা খানেক পর ভদ্রলোক গন্তব্যে চলে আসে। এরপর বাবু নামার পর বললেন, চিঠিতে লিখবেন আপনার ঠিকানা? বললেন আপনার নাম জানা হলো না। আপনার নাম? 'আবদুল রসুল'। ধমকে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন তুমি কি মুসলমান? আবদুল রসুল সাহেব বললেন - হ্যা, আমি মুসলমান। ভদ্রলোক মুখ খিঁচিয়ে বললেন, কেন?-কেন জাতটা মারলে? খাবার সময় কেন বললে না তুমি মুসলমান? উল্লুক। রসুল সাহেব অবাক হয়ে বললেন - আপনি তো বললেন আপনি জাত মানেন না! তিনি তেড়ে এসে তার নাকের কাছে হাত নেড়ে বললেন মানি খুব মানি এবং আলবৎ মানি। সাত পুরুষ মেনে এসেছেন আর আমি মানিনে! (অবাক বাংলাদেশ, আকবর আলী খান)।

আসলে আমরা মুখে মুখে অনেকেই ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি কপচাই; আসলে আমরা অন্তরে ধর্মান্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের উপর নির্যাতনের চিত্র টেলিভিশন, প্রত্রিকায় প্রায় দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের সংবিধানের মূলনীতিতে সুস্পষ্ট ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ্য করা আছে, তাছাড়া সংবিধানের ২৭, ২৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী ও কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের বৈষম্যর কারনে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য করতে পারবে না। আমার প্রশ্ন হলো রাষ্ট্র সকল ধর্মের মানুষকে সাম্য ও সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং সরকার সকল ধর্মের মানুষদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন রকম উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতি প্রনয়ন করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। তারপরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও এক ধর্মের অনুসারী অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি দেওয়ার প্রবনতা কেন সৃষ্টি হয়েছে?

সৈয়দ মুজতবা আলীর এই গল্পটি আমাদের এটাই শিক্ষা দেয়, আমরা মুখে মুখে অনেক কিছু বলি কিন্তু অন্তরে এখনও আমরা প্রাগৈতিহাসিক পৌরাণিক মতামত লালন করি। যদি অন্তরকে পরিষ্কার আমরা না করতে পারি যত আইন করা হোক বা যত পরিকল্পনা করা হোক আমরা এই সমস্যা থেকে কখনও বের হতে পারবো না। প্রতিটি ধর্মের মানুষকে এই কথাটি বিশ্বাস করতে হবে "সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর কেহ নাই" কিন্তু আমরা এই বিশ্বাস লালন করি কত জনে? আমাদের কারও রক্ত সাদা নয়? সবার রক্ত লাল। আমাদের উচিত হবে অন্তরকে পরিষ্কার করা ও সদা নিজ ধর্মের ধর্মীয় নীতি, মুল্যবোধ লালন ও পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সন্মান এবং ভালবাসা প্রদর্শন করা তা না হলে আয়নার সামনের অংশটুকু যেমন মসৃণ থাকবে তেমনি পেছনের অংশ ততটুকু অমসৃণ ও মলিন হবে এবং জগৎসংসারে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি থেকে যাবে।

লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও প্রভাষক
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: