আজকে আমার মন ভালো নেই!

ইমরুল কবির | ২৮ জুন ২০২২, ০৯:১৬

ইমরুল কবির

কয়েকদিন থেকে ফেইসবুকে একটি কথা সবাই শেয়ার হচ্ছে বার বার, আমি ভালো নেই, রসিকতা হোক আর মজা হোক বর্তমানে ফেইসবুকের পাতায় কথাটি এত এত শেয়ার দেখে নিজে একটু অট্টহাসি পেলো, হঠাৎ পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে নিজের চোখের পাতা কুঁচকে গেল, “বসবাসের বাসযোগ্যতায় তলানির দিকে ঢাকা"। আমরা ভালো নেই কারণ আমাদের রাজধনী দেশের সকল কিছু যেখান থেকে পরিচালিত হয় সেই প্রিয় ঢাকা শহর ভালো নেই।

একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল-
"নকশী কাঁথার মাঠ ছাড়িয়ে তুমি ছাড়িয়েছো আমাদেরই বুকে
হ্যাঁগো শহর, হ্যাঁ তোমায় বলছি...তুমি কি সত্যিই আছো সুখে?"

আমাদের শহর সত্যি সুখে নেই,বাসযোগ্যতার বিচারে ঢাকা শহরের তেমন উন্নতি হচ্ছেনা। রাজধানী হিসাবে ঢাকার ইতিহাস অনেক পুরোনো। পূর্বে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো বিহারের রাজমহল, সুবা বাংলায় তখন চলমান ছিল বারো ভুঁইয়াদের শাসন।মোঘল বিরোধী স্বাধীন বারো ভুঁইয়াদের কাছ থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে ১৫৭৬-১৬০৫ খিষ্ট্রাব্দ পর্যন্ত বারংবার চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু মোঘলরা বারো ভুঁইয়াদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৮ সালে ইসলাম খান চিশতিকে রাজমহলের সুবেদার নিযুক্ত করে, সুবেদার ইসলাম খাঁ দায়িত্ব গ্রহণের ৫ বছরের মাথায় বারো ভুঁইয়াদের পতন ঘটে বর্তমান চট্রগ্রামের কিছু অংশ বাদে সমস্ত বাংলা মোঘলদের অধীনে চলে যায়।

১৬১০ সালে ঢাকা বাংলার প্রথম রাজধানী হয়, ১৬৩৯ সালে শাহ সুজা সুবেদার হলে তিনি ঢাকাকে দ্বিতীয় বার বাংলার রাজধানী করে। ১৬৬০ সালে মীর জুমলা ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করে, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বাংলার রাজধানী হয়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে ঢাকা বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয় এবং সর্বশেষ মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের পর ঢাকা বাংলার রাজধানী হয়। ঢাকা ছিল নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দয্যপূর্ণ একটি নগরী এবং ঢাকা শহরের নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর স্বচ্ছ পানি এবং আবহমান ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবে ঢাকা আজ যেন একটি অতীত (ঢাকা কোষ, এশিয়াটিক সোসাইটি)।

কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্যা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ই আই ইউ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের অবস্থান ১৭২ টি দেশের মধ্যে ১৬৬ তম (বিশ্ব বাসযোগ্য শহর প্রতিবেদন, ২০২২ ই আই ইউ) ই আই ইউ এর প্রতিবেদনে পাঁচটি বিষয়কে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেই বিষয়গুলো হল স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ও শিক্ষা ও অবকাঠামো। বাসযোগ্যতা তালিকা নির্ধারণের জন্য পাঁচটি সূচকের প্রতিটিতে ১০০ নম্বর ধরা হয়েছে, এর মধ্যে ঢাকা পেয়েছে স্থিতিশীলতায় ২৫ শতাংশ নম্বর, স্বাস্থ্য সেবায় ২০ শতাংশ নম্বর, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সূচকে ২৫ শতাংশ নম্বর, শিক্ষা খাতে ১০ শতাংশ নম্বর এবং অবকাঠমোতে ২০ শতাংশ নম্বর। ঢাকাতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ বসবাস করে এবং ঘনবসতির দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান এক নম্বর তাছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বর্তমানে ১ কোটি ৬৪ লাখ লোক বসবাস করে। যার চিত্র অত্যন্ত দুর্বিষহ। কেনই বা এসকল চিত্র বার বার ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্যতায় পরিণত করে এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল একটি যানজট। রাস্তায় কোন শৃঙ্খলা নেই, ট্রাফিক আইন অমান্য করার কোন কঠিন ব্যবস্থা নেই, বাসের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব, যাত্রী তোলার অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা ও চালকদের দক্ষতা ও অসাবধানতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকাতে ঘনবসতি অনেক যার ফলে রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন থাকে এবং ঢাকাতে অতিরিক্ত ঘনবসতি থাকার কারণে বিল্ডিংগুলো অপরিকল্পিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।ভবনগুলো একটির গায়ে গায়ে অন্যটি লাগানো যার ফলে মানুষের প্রাইভেসিও থাকছে না। এইসকল কারণগুলো বারবার ঢাকাকে অস্থিতিশীল নগরীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ঢাকা শহরের ২০ শতাংশ এলাকায় পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে ৮০ শতাংশ এলাকায় সেটা অনুপস্থিত এর ফলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে পানি জমে যায়, তীব্র দুর্গন্ধ দেখা দেওয়া ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ড্রেন বা সুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা নগরীর অব্স্থা দিনকে দিন করুণ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত ভবন ও আবাসনের কারণে কারণে বৃষ্টির পানি খালে বিলে যাওয়ার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে , কেবল সাধারণ মানুষ নয়,ঢাকা শহরের নামিদামি আবাসিক এলাকাগুলোতে অবস্থা ঠিক একই রকম । জলাবদ্ধতা ও পয়নিষ্কাশনের অভাবের কারণে ঢাকা শহরের বসবাসকারী অনেক জনসমষ্টির মধ্যে বিভিন্ন রকম পানিবাহিত রোগ ও মশার উপদ্রব দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। যার ফলে সুস্থ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ব্যহত হচ্ছে। যার ফলে ঢাকা দিন দিন বসবাসের অযোগ্যতায় পরিণত হচ্ছে। ঢাকার নির্মল পরিবেশ নিয়ে সব সময় কথা উঠে, দূষিত বায়ুর দিক দিয়ে ঢাকা পৃথিবীর প্রথম। ঢাকা ওয়াসা এই শহরের মানুষের জন্য যে পরিমাণ পানি সরবারহ করে থাকে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত কিন্তু ঢাকার আশেপাশে থাকা বিভিন্ন নদীর পানিগুলো যদি দূষণের হাত থেকে রক্ষা করি এবং সঠিক ব্যবহার করি তাহলে পানির সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে কিন্তু তা হচ্ছে না পরিকল্পিত ব্যবস্থার অভাবে।

প্রাচীনকালে ঢাকা ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। গুণগত শিক্ষার মানের জন্য প্রয়োজন গুণগত শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করা, যদি ছোট্র নগরীরতে ২ কোটি লোক বাস করে তাহলে কিভাবে গুণগত শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন হবে। গুণগত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা, মানসিক উন্নয়ন,সাহিত্যের প্রসার কিন্তু ঢাকা শহরের এখন তা আগের নেই বাচ্চারা না পাচ্ছে খেলার মাঠ, সংস্কৃতি চর্চার জন্য পরিবেশ,মানসিক উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সবুজ ঘেরা কোন বিনোদন কেন্দ্র যার ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ঢাকার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। ঢাকা শহরের পরিবেশের কথা বলতে গেলে চোখ কপালে তুলতে হয়। পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ একটি নিত্য ঘটনা। ঢাকা শহরে শব্দের গড় ১০০ ডেসিবল কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য প্রয়োজন ৫০ ডেসিবল।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শব্দ দূষণের মাত্রা এভাবে চললে ঢাকা শহরের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। বায়ু দুষণের কারনে প্রতিদিন ১৮ হাজার মানুষ ঢাকায় মৃত্যু বরণ করে। ঢাকা শহরের আশেপাশে প্রায় ১২০০ টি ইটের ভাটা আছে যেগুলো ঢাকা শহরের বায়ু দূষণে ৫৮ শতাংশ দায়ী। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন, গ্রহনযোগ্য সেই অক্সিজেন যদি বিশুদ্ধ না হয় তবে শরীরে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয় যেমন: হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি বায়ু দূষণের জন্য হয় দায়ী কিন্তু ঢাকা শহরের বায়ু প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন যানবাহনের ধোঁয়া ও নগরায়ন। রাজধানী ঢাকাতে বেঁচে থাকার আরেকটি সমস্যা পানি দূষণ, ঢাকা শহরে পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া অন্যতম নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা শিল্পকারখানার বর্জ্যের পাশাপাশি বসতবাড়ি ও হোটেল, রেস্তেরাঁর উচ্ছিষ্ট ভরে গেছে নদীতে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা, বালু নদী ঢাকাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে এবং এই নদীগুলো ক্রমাগত বিভিন্ন কারণে দূষণ ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে যা বসবাসের অযোগ্যতার দিকে ঢাকা শহরকে নিয়ে যাচ্ছে।

দেশ উন্নয়ন হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্রমাগত উন্নয়নের ফলে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু দেশের রাজধানী বা প্রাণ যদি দিন দিন বসবাসের অযোগ্য নগরীর দিকে চলে যায় এটা দেশের জন্য কখনও কল্যাণকর নয়। পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী, কোথায় স্কুল-কলেজ হবে, কোথায় হাসপাতাল, অফিস আদালত , জনবসতি গড়ে উঠবে তা হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে শহরে বসবাসরত মানুষের জীবন হবে সুখি ও স্বাস্থ্যসম্মত। ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সকলের উচিত সরকারকে সঠিক সহযোগিতার মাধ্যমে ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা।

আমাদের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদুতীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন । অথ্যাত্তথ সংবিধানীকভাবে রাষ্ট্রের উচিত হবে এমন ভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাতে গ্রাম ও শহরের উন্নয়ন সমানভাবে হয় এবং মানুষ শহরমূখি না হয়ে গ্রামে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। যদি ঢাকা শহরের ঘনবসতি কমানো যায় এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় তাহলে ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য নগরীতে পরিণত করা যাবে।ঢাকা আমাদের শহর এবং ঢাকা শহরকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলা আমাদের দায়িত্ব

লেখকঃ উন্নয়ন গবেষক ও প্রভাষক
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: