৭ই মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন সৃষ্টির প্রেক্ষিত

ইলিয়াস সানী | ৭ মার্চ ২০২২, ১০:৪৫

ছবিঃ সংগৃহীত

বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা শব্দটির পিছনে রয়েছে লাখো শহীদের রক্তের ঝর্ণাধারা। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ৭ ই মার্চের অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় প্রস্ফুটিত বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন। সেই ৭ ই মার্চেরও আছে এক রক্তঝরা সংগ্রামের ইতিহাস। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বাঙালি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ এমনই এক পরিস্থিতিতে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতায়। সমসাময়িক সময়ে এমনই এক প্রেক্ষাপটে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, রাজনীতির কবি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির স্বাধীনতার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ, ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। বিক্ষুব্ধ বাঙালি সারা ঢাকা শহরেই বিক্ষোভ মিছিল করে। সামরিক আইন পরিচালক লে. জে. সাহেবজাদা এম ইয়াকুব খান ১১০ নং সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করেন।
শুরু হয় উত্তাল মার্চ।

দোসরা মার্চ থেকে রাতভর কারফিউ জারি করে ইয়াহিয়া সরকার। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ৩-৬ মার্চ আধা বেলা হরতালের ডাক দেন। ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে জাতীয় শোক দিবস পালনের আহ্বান জানান। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে কর্মরত বাঙালিদের প্রতি ইয়াহিয়া সরকারের বাঙালি কন্ঠরোধের প্রচেষ্টা কে নাকচ করে দিতে বলেন।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ, ২ ঘটিকায় রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশের ডাক দেন।

ক্ষমতা লিপ্সু ইয়াহিয়া আরও হিংস্র হয়ে উঠেন। শুধু তেসরা মার্চেই গুলিতে ঢাকায় ২৩ ও চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া সরকারের হিংস্রতা আঁচ করতে পারেন। ১০ মার্চের ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা শুধুই কালক্ষেপণ ছিলো। বঙ্গবন্ধু নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। প্রকৃতপক্ষে ৩ মার্চে, পল্টনে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধিকারের চেতনাকে নতুন রুপে উজ্জীবিত করেন। বাঙালির স্বাধিকারের দাবি উত্থাপন করেন।
শেখ মুজিব বলেন, ‘হয়তো ইহাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হইতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলিয়া যাইতেছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।’

৪ মার্চেও ইয়াহিয়া সরকারের হিংস্রতা অব্যহত। চট্টগ্রামে নতুন করে ৪৬ জন নিহত, খুলনায় ৬। ঢাকার কারফিউ শিথিল।
সাংবাদিক ও শিল্পীদের একাত্মতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি। ২০ জন বিশিষ্ট শিল্পীর যুক্তবিবৃতি, বেতার টেলিভিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত।
ছাত্রলীগ ও ডাকসুর আবেদন, ৬ মার্চের মধ্যে ঢাকা শহরে এবং ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন শেষ করতে হবে। প্রতিটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ১ জন আহ্বায়ক ও ১০ জন সদস্য থাকবে।

৫ মার্চেও ইয়াহিয়া সরকারের বর্বরতা অব্যহত। টঙ্গী তে গুলিতে নিহত ৪, আহত ২৫। এদিন চট্টগ্রামেও নতুন করে ১৭ জন নিহত। রাজশাহী, রংপুরে নতুন করে কারফিউ জারি। একদিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকারের ডাকে বাঙালি বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে, অপরদিকে এদিন ইয়াহিয়া-ভুট্টো ৫ ঘন্টার এক ম্যারাথন বৈঠক করেন রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে। বাঙালি হত্যার নীল নকশা নির্ধারিত হয় নিশ্চয়ই।
এদিন স্বাধিকার আন্দোলনে শামিল হলন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। চলমান দমন-পীড়নকে গণহত্যা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির বিবৃতি।

অপরদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ ও যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা দেন বুয়েটের শিক্ষকরা। ৬ মার্চে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের ডাক দেন। এদিন টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলি ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত, সান্ধ্য আইন অব্যাহত। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণ- ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত।
ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভেঙে সাড়ে তিনশ কয়েদির পলায়ন। গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত।

অতীতের ন্যায় মার্চের প্রথম দিন থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত বাঙালির রক্তেরও চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয় ৭ মার্চ। কবি মঞ্চে উপবিষ্ট হন এবং বাঙালির স্বাধীনতার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে যান।

৭ মার্চের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভালবাসা জানাচ্ছি বাঙালির রাখাল রাজা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

লেখক, প্রভাষক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: