আ.লীগের নামে ভুঁইফোড় সব সংগঠনের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে আইনি ব্যবস্থা

সময় ট্রিবিউন | ৩১ জুলাই ২০২১, ১৯:০১

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের লোগো- ফাইল ছবি

বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অনন্য উজ্জ্বল রাজনৈতিক দলের নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের ইতিহাসে এমন কোনও অধ্যায় পাওয়া যাবে না, যেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবদান নেই। এমনকি বাংলাদেশ নামক দেশটির অভ্যুদয়ের পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরাট অবদান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

দীর্ঘ সংগ্রাম আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারের পর ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সংগঠটি। তবে গত এক দশকে আওয়ামী লীগ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে শতাধিকেও বেশি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনগুলোকে ‘দোকান’ বলা হয়ে আসছে প্রায় এক যুগ থেকেই। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সোচ্চার হয়েছে এই সংগঠনটি। পুলিশও তৎপর রয়েছে এসব  ভুঁইফোড় ও নামসর্বস্ব সংগঠনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে।

নামের আগে-পরে ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ যুক্ত করে ২০০৯ সালের পর যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, এর প্রায় সবই ভুঁইফোড় বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসব সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সেটাও খোঁজা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তাঁর মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ভবনে অভিযান চালায় র‌্যাব।

সম্প্রতি ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এরপর তাঁকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবার নির্বাচনের আগে বা সরকার গঠনের পর কিছু সংগঠন গজিয়ে ওঠে। মূলত, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া কিংবা বাদ পড়া এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কেউ কেউ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ২০১৫ সালে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে শতাধিক সংগঠনের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। এরপর কিছুদিন এদের তৎপরতা কিছুটা কমে যায়।

আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে পুনরায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারের লোভে এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে গিয়ে দু-একজন মন্ত্রী-নেতা প্রতারিত হওয়ার কথাও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলেছেন। সরকারি কর্মকর্তারাও ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে নালিশ করেছেন। এরপর সম্প্রতি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুনরায় ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দলটির রাজনীতির ওপর নানা ধরনের ধমন-পীড়ন চলে। এ সময় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব সংগঠনের নামের আগে-পরে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম আছে। এ সংগঠনগুলো দুর্দিনে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এসব সংগঠন আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম মর্যাদা না পেলেও দলের নীতিনির্ধারকেরা মর্যাদার চোখে দেখেন। এদের কর্মকাণ্ডকে মূল্য দেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেখ রাসেল শিশু-কিশোর, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলাসহ কয়েকটি সংগঠন বেশ পুরোনো। এগুলোর বিষয়ে দলের নেতাদের মনোভাব ইতিবাচক। কিন্তু ২০০৯ সালের পর প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময় বেশির ভাগ সংগঠনই গড়ে তোলা হয়েছে তদবির –বাণিজ্যের লক্ষ্যে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘আমরা মাঠে রাজনীতি করি। এসব ভুঁইফোড়, স্বার্থান্বেষীরা কখন কোথায় ছবি তুলে বসে, সেই আতঙ্কে থাকি।’

তিনি আরও বলেন, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন আওয়ামী লীগকে বিব্রত করছে। তাদের বিরুদ্ধে দল কঠোর। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, কিছু ভুঁইফোড় সংগঠনকে মন্ত্রী হওয়ার ‘মঞ্চ’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। কারণ, অনেকেই এসব সংগঠনে ‘গরম’ বক্তৃতা করার পর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করারও অভিযোগ আছে। মন্ত্রী হওয়ার পরও কেউ কেউ এ সম্পর্ক ধরে রাখেন। এ সুযোগ নেন সংগঠনের উদ্যোক্তারা। করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে সভা-সমাবেশ অনেকটাই কমে গেছে। এখন তাঁরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সক্রিয়।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন আটটি। এগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে দুটি—ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ।

এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’–এর অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত সংগঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো অনুমোদনের ধার ধারে না।

আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরা দল বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধার ধারে না। নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতাকেও এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে যেতে দেখা যায়। অনেকেই পরে মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ২০১৪ সালের পর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া অন্য নেতারা পুনরায় এসব সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। পরে তাঁদের অনেকেই ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান।

এবিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে যেকোনো নামের সঙ্গে ‘লীগ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের রয়েছে সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং বিভিন্ন উপ-কমিটি।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, দলীয় সভানেত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দলের মধ্যে কারও প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। দলের নাম ভাঙিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: