লুঙ্গিই আপনার পোষাক, আপনার ঐতিহ্য

সময় ট্রিবিউন | ৩১ জানুয়ারী ২০২২, ০৪:৩২

মাহামুদুল হক-ফাইল ছবি

মাহামুদুল হক:

লুঙ্গি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে একজন নারীবাদী লেখক পূরুষের এমন ঐতিহ্যবাহী পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে লেখার কারণে। গ্রামে আমরা যারা ছিলাম তখন হাফ প্যান্টের জীবন শেষ হলেই আমাদের পদোন্নতি হতো লুঙ্গি পরা দিয়ে। ফুল প্যান্ট বা ট্রাউজার তখনও গ্রামে অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিলো। গ্রামের হাইস্কুলেও ফুলপ্যান্ট দু/চারজন পরে যেতো। লুঙ্গি পরে কৃষকরা কাজ করতো, শিক্ষার্থীরা স্কুলেও যেতো। বাসায় বড়রা সবাই লুঙ্গি পরতো। আমি লুঙ্গি পরার প্রমোশন পাওয়ার পর মায়ের নিকট ছোট-খাটো বকা খাইতাম প্রায়ই। কেননা, আমি ভালো করে লুঙ্গি বাঁধতে পারতাম না, নীচের দিক গোলাকার সমান হতো না। এরপর যখন শহরে প্রবেশ করলাম, সুযোগ পেয়ে ট্রাউজার পরা ধরলাম। এরপর কখনো লুঙ্গি পরি না। এর অর্থ এই নয় যে লুঙ্গিকে পছন্দ করি না। ঐতিহ্যবাহী এ পরিধেয় বস্ত্রকে যেভাবে অপমান করলেন লেখিকা সেটা মেনে নেওয়া যায় না। নারীবাদিতা মানে পূরুষবিরোধিতা নয়, পূরুষকে অপমান করাতো নয়ই। আর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ধারণ ও লালন সকল জ্ঞান কাঠামোয় আবর্তিত হয়৷

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে মাঠ-ঘাট ও নদী পেরিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়। এজন্য গ্রামীণ জনগণের জীবন-জীবিকার হাতিয়ারও লুঙ্গি। এই লুঙ্গি পরিধানকারীদের অপমান করা ও লুঙ্গিকে যৌনতার হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা কোন সৃজনশীল মানুষের কাজ হতে পারে না।

লুঙ্গি পরিহিত রিক্সাওয়ালাকে রাজধানীর বারিধারার অভিজাত এলাকায় রিক্সা নিয়ে একবার ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এই নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিলো সাধারণ মানুষ। লুঙ্গি পরে ওই এলাকায় মানববন্ধনও করা হয়েছিলো। গণমাধ্যমও বিষয়টি ভালোভাবে প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি তখন ডেইলি স্টারের মেট্রো এডিটর। এসময় নিউজরুমে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক ডেইলি স্টারের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান ভাইয়ের সঙ্গে লুঙ্গি পরার উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা হচ্ছিল। এমন সময় বদরুল ভাইকে অনুরোধ করলাম ভাই লুঙ্গি নিয়ে কিছু একটা লিখুন যাতে তথাকথিত অভিজাতগণ টের পান। বদরুল ভাই বলার এক ঘন্টার মধ্যেই ৭০০-৮০০ শব্দে লুঙ্গির আদ্যপান্ত রম্যরচনা লিখে বারিধারাবাসীদের লুঙ্গির পরিবর্তে বাঁশ দিলেন। লেখাটি আমি ডেইলি স্টারের মেট্রো পেজে বক্স করে দিলাম তৎক্ষনাৎ। পরদিন প্রকাশিত হলো, ভাইরাল বদরুল ভাইয়ের লেখা! বারিধারা সমিতি ও তথাকথিত অভিজাত জনগোষ্ঠী লুঙ্গির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

লুঙ্গি পরিহিতদের অপমান করা মানে বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অপমান করা। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রংপুরের রহিম উদ্দিন ভরসাকে লুঙ্গি পরে মোটর সাইকেলের শোরুমে ঢুকে মোটর সাইকেলের দাম জিজ্ঞেস করায় দাম বলেননি সেলসপারসন।  সেলসপারসন মনে করেছিলেন এতো লুঙ্গি পরা লোক, কিনতে পারবেনা। পরে ওই শোরুমের সকল মোটরসাইকেল জেদ করে কিনে নিয়েছিলেন রহিম উদ্দিন ভরসা। লুঙ্গি পরা লোকদের ছোট ভাবার কোন অধিকার আপনার নেই। কোর্ট-টাই-প্যান্ট আপনার পোষাক নয়। লুঙ্গিই আপনার পোষাক, আপনার ঐতিহ্য। আপনি প্রতিদিন যে খাবার ফলমূল খান তাতে রয়েছে কৃষকের লুঙ্গির ছোঁয়া।

লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।  


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: