‘খালেদা-বাবুনগরীর গোপন বৈঠকে পরিকল্পনা হয় শাপলা চত্বরের নাশকতার’

সময় ট্রিবিউন | ২১ এপ্রিল ২০২১, ০৫:৩৭

ফাইল ছবি

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ কর্মসূচির এক সপ্তাহ আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। সেখানে করা গোপন বৈঠকে পরিকল্পনা করা হয় শাপলা চত্বরের নাশকতার। এমনকি ওই সময় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন হেফাজত। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নাশকতায় রূপ দিয়েছিলো। সেদিনের নাশকতার পেছনের মূল কারণ, বিএনপি-জামায়াতের কোন কোন নেতার সঙ্গে হেফাজত সাক্ষাৎ, হেফাজত ছাড়াও আর কারা ছিলেনসেইসব তথ্য ফাঁস করলেন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর কমিটির তৎকালীন প্রচার সম্পাদক প্রভাবশালী নেতা মুফতি ফখরুল ইসলাম।

সোমবার (১৯ এপ্রিল) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছেন হেফাজত নেতা মুফতি ফখরুল ইসলাম।

গত ১৪ এপ্রিল লালবাগ এলাকা থেকে মুফতি ফখরুলকে গ্রেফতারের পর পাাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ড শেষে সোমবার (১৯ এপ্রিল) তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জবানবন্দিতে যা বলেছেন

মুফতি ফখরুল জানিয়েছেন, তিনি কামরাঙ্গীরচর জামিয়া নূরীয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। হেফাজতে ইসলামের আগের কমিটির ঢাকা মহানগরীর প্রচার সম্পাদক ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও মারকাজুল আজিজ মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত।

জবানবন্দিতে ফখরুল ইসলাম বলেন, “২০১৩ সালের ৫ মে সকালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুন্নলাহ ফোন করলে কারাঙ্গীরচর মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার আট থেকে ১০ হাজার হেফাজত কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে লালবাগ-চকবাজার হয়ে নয়াবাজারে আসি। জোহরের নামাজের পর দুইটার দিকে তার কথায় সবাইকে নিয়ে শাপলা চত্বরে যাই।”

জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, “শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় গোলাপশাহ মাজারের (গুলিস্থান) সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এসময় উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তারা সেখানে ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। অবশেষে বেলা তিনটার দিকে তার নেতৃত্বে পাঁচ থেকে সাত হাজার শাপলা চত্বরে পৌঁছায়। শাপলা চত্বরে গিয়ে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহ রব ইউসুফি, জুনায়েদ আল হাবিব, মামুনুল হক, মাওলানা জাফর উল্লাহ, আবুল হাসনাতমহ অনেককেই দেখতে পান। এর মধ্যে ৪৩ জনের নাম জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন তিনি। ১৩ দফা দাবি আদায় না করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলন হবে বলে তাকে জানিয়েছিলেন মামুনুল হকসহ হেফাজত নেতারা।”

তিনি জানিয়েছেন, “মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী তাকে বলেছেন, আন্দোলন ও সহিংসতার বিষয়ে দুজন বিএনপি নেতা এবং একজন জামায়াত নেতা তাদের অর্থ সহযোগিতা করছে। এছাড়া ওই বছরের ২৮ এপ্রিল বাবুনগরীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার গোপন বৈঠক হয়েছে। বৈঠকেই হয়েছে শাপলা চত্বরে নাশকতার পরিকল্পনা। হেফাজতের প্রোগ্রাম শাপলা চত্বরে স্থায়ী হলে বিএনপি-জামায়াতও যোগ দেবে বলে আলোচনা হয় বৈঠকে। পরে ৫ মে দুপুর থেকেই বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা রাস্তায় বাধা সৃষ্টি ও আগুন দেওয়া শুরু করে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘হেফাজত নেতা মুফতি ফখরুল ইসলাম রিমান্ডেই বলেছিলেন তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেবেন। এরপর গত সোমবার আদালতে জবানবন্দি দেন। এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।’

একাধক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানায়, ২০১৩ সালের ৫ মে’র একদিন আগে ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে নেতাকর্মীদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের একটি অংশ দ্বিমত পোষণ করায় সাংগঠনিকভাবে হেফাজতের অবরোধে অংশ নিতে পারেনি বিএনপি। বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা হেফাজতের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। তবে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই হেফাজতের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল।

এদিকে আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এক আলোচনা সভায় হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সলিমুল্লাহ দাবি করেন, ‘২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার দায় বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর। তিনি তখন হেফাজতের মহাসচিব ছিলের। শাপলা চত্বরে রাতে অবস্থানের কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না। রাতে থাকলে সেনাবাহিনী নামবে বলে তিনি (বাবুনগরী) একক সিদ্ধান্তে রাতে অবস্থানের নির্দেশ দেন।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২০১৩ সাল থেকেই জুনায়েদ বাবুনগরী বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আহমদ শফীর জন্য আগে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর বাবুনগরীর আমীর নির্বাচিত হলে হেফাজত পুরোপুরি ‘অ্যান্টি গর্ভনমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজ’ শুরু করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে গত বছরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিরোধিতা শুরু করে চলতি বছরের মোদীবিরোধী আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করেছে।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: