কে এই গোলাম সাকলায়েন শিথিল?

সময় ট্রিবিউন | ৮ আগষ্ট ২০২১, ০৩:৩০

গোলাম সাকলায়েন শিথিল ও পরীমনি-ফাইল ছবি

গত ১৩ জুন ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করেন চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণি। এর পরদিনই উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে। পরে এই ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ পরীমণিকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্ত করতে গিয়ে চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণির সঙ্গে পরিচয় হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার গোলাম সাকলায়েন শিথিলের সঙ্গে। এরপর থেকেই শুরু হয় যোগাযোগ।

এরপর সেই সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রেমের সম্পর্ক। এরপর নিয়মিত পরীমণির বাসায় যাতায়াত শুরু করেন সেই পুলিশ কর্মকর্তা। মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বের হতেন দুজনে। বিবাহিত সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন অবিবাহিত হিসেবে। সর্বশেষ পরীমণি সেই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় এসে অবস্থান করেন প্রায় ১৮ ঘণ্টা। পরীমণি গ্রেপ্তারের পর অকপটে স্বীকার করেছেন সবকিছু। বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হওয়ায় আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিবি থেকে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু সবার মাঝে একটাই প্রশ্ন কে এই গোলাম সাকলায়েন শিথিল?

৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যোগ দেওয়ার পর পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছিলেন সেরা, পেয়েছিলেন বেস্ট প্রবিশনারি অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্সেও হয়েছিলেন প্রথম। পেশাগত দক্ষতার জন্য তিনি যে আরও অনেক পুরস্কারই পাবেন, সেটিও ছিল অনুমিত। সর্বশেষ সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে পদক বিতরণ করেছেন, তাতেও তাই স্বাভাবিকভাবেই ছিল তার নাম। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পিপিএম পদক গ্রহণ করা এই পুলিশ কর্মকর্তাই হলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও বন্দুকযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজ ও অসীম সাহসিকতার জন্যই তাকে এই পদক দেওয়া হয়।

সাকলায়েনর স্ত্রীও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় তার স্ত্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এমন সাফল্য আর স্বীকৃতি একের পর এক ধরা দিলেও গোলাম সাকলায়েনের জীবনের উত্থানের পথ একটা মসৃণ ছিল না। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার পাড়ে মোক্তারপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল সংগ্রাম মুখর। মেধা আর পরিশ্রমে অবশ্য সব প্রতিকূলতা জয় করেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন সাকলায়েন। 

পিপিএম পদক পাওয়া গোলাম সাকলায়েন ২০০১ সালে সারদা সরকারি পাইলট একাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ ৫ না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিল। কিন্তু তার গ্রামের জন্য এটিই ছিল অভাবনীয় ফল। পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে সাকলায়েনকে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সাকলায়েনের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো অনেক অর্থ। সাকলায়েনকে তাই রাজশাহীতে মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার সাইকেলে করে চারঘাট থেকে রাজশাহী প্রায় এসে কলেজ করতেন।

এত সব মিলিয়ে এইচএসসি’র ফলটাও আশানুরূপ ছিল না, পেয়েছিলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৮০। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষায় এ বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। ক্লাস শুরু করেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে সাধারণ জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবেও যোগ দেন। এসময় শুরু করেন টিউশনি। নিজে কখনও প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর পড়িয়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলে-মেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।

সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল পাওয়ার আগেই ‘অবতীর্ণ’ বা ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করেন ৩০তম বিসিএসে। কিছু না বুঝেই প্রথম চয়েজ দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। পরবর্তীতে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন সাকলায়েন। ৩০তম বিসিএসের কার্যক্রম যখন চলছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন সাকলায়েন। একইসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবেও টিকে যান, যোগ দেন সেই চাকরিতেই। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সে অবস্থাতেই অংশ নেন ৩০তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায়। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষাতেও।

এরপর শুরু সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। মন দিয়েই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাতে হয়েছেন প্রথম। বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে পরে পেয়েছেন বেস্ট একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। বিভাগের সবার পরামর্শে পেশাগত দক্ষতার তাত্ত্বিক জ্ঞান বাড়িয়ে নিতেই একসময় ফের ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুলিশ সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। এবারে তাতেও প্রথম হন তিনি।

চীনের একটি প্রবাদ— ‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’। এই প্রবাদটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল।

কিন্তু সমালোচিত অভিনেত্রী পরীমনির সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িতে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে ডিবি থেকে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (দাঙ্গা দমন বিভাগ, পশ্চিম) বদলি করা হয়। এছাড়া সাকলায়েনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: