নাবিকদের উদ্ধারে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে চলছে চেষ্টা

সময় ট্রিবিউন | ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৯:৫৩

ফাইল ফটো
ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের মধ্যে মঙ্গলবার রাতের পর থেকে একজনই ফোন করেছেন এসআর শিপিং কর্মকর্তার কাছে। বুধবার সকাল ৭টায় ফোন দেওয়ার পর অন্য কেউ যোগাযোগ করেননি। অন্য ক্রুদের সঙ্গে বুধবার বিকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। 
 
জাহাজটির মালিক পক্ষ এসআর শিপিং, মার্চেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশন, ডিজি শিপিং কার্যালয় থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। বুধবার সন্ধ্যায় পাওয়া সবশেষ স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূল থেকে ১৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে। সোমালিয়া উপকূল পর্যন্ত পৌঁছতে আরও ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে জানান পর্যবেক্ষণকারী কর্মকর্তারা।
 
এদিকে জলদস্যুদের হাতে আটক জাহাজ ও জিম্মিদের উদ্ধারে কূটনৈতিক চ্যানেলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তবে বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
 
জাহাজটির উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, জিম্মি হওয়া জাহাজটি উদ্ধারে এরই মধ্যে আমরা কুয়ালালামপুর, নয়াদিল্লি, সিঙ্গাপুর, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের সব জাহাজ বন্দরে বার্তা পাঠিয়েছি। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। থার্ড পার্টির মাধ্যমেও আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি।
 
এ ছাড়া আটক জাহাজ এবং ক্রু-নাবিকদের যেকোনো মূল্যে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে ফেরত আনতে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত থাকা খবর অনুযায়ী নাবিকরা সুস্থ ও ভালো আছেন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য জায়গাগুলোতে তিনি কথা বলেছেন। নাবিকদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বুধবার সচিবালয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরে ফেরি, স্টিমার, লঞ্চসহ জলযান সুষ্ঠুভাবে চলাচল এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্মপন্থা গ্রহণের বৈঠকের শুরুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
 
নিরাপদ সমুদ্রপথে চলার সময় জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। বাংলাদেশি শিপিং প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা আছে। এ সমুদ্রপথ ছিল ‘রিস্কি জোন’ থেকে অন্তত ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে। জলদস্যুরা ছিনতাই করা একটি ইরানি নৌযানে করে ওত পেতে থাকে এমভি আবদুল্লাহর চলাচল পথে। জাহাজটি বাগে পেয়েই উঠে পড়ে ৫০ সদস্যের বিশাল জলদস্যু দল।
 
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, জাহাজটি এখন সোমালিয়া উপকূলের দিকে যাচ্ছে। বুধবার জাহাজটির স্যাটেলাইট ইমেজ পেয়েছি আমরা। তবে বুধবার নাবিক, ক্রু কিংবা জলদস্যুদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়নি।
 
তিনি বলেন, জাহাজটিতে পর্যাপ্ত জ্বালানি আছে। জলদস্যুদের চাওয়া থাকবে একটা মুক্তিপণ। টাকা পেলেই তারা ছেড়ে দেবে।
 
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, জলদস্যুদের এত বড় দল আর কখনো জাহাজ নিয়ন্ত্রণ নেয়নি। দস্যুরা ২৩ নাবিকের সবার মোবাইল ফোনসহ যোগাযোগের সব মাধ্যম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সবশেষ পাওয়া খবরে জানতে পেরেছি শুধু জাহাজের অভ্যন্তরীণ ওয়াই ফাই ব্যবস্থা সচল আছে। এটি যদি দস্যুরা জানতে পারে তবে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস দেখা দেবে। তখন ‘যেকোনো কিছু’ করতে পারে তারা। জাহাজটিতে নিরাপত্তারক্ষী পর্যাপ্ত ছিল কি না-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ছিল না। কারণ আন্তর্জাতিক নৌপথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে বাড়তি জনবল রাখার সুযোগ নেই।
 
এদিকে ডিজি শিপিংয়ের মাধ্যমে উদ্ধারকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন উদ্ধারকারী সংস্থার কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিজি শিপিং কমডোর মো. মাকসুদ আলম বুধবার সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নৌবাহিনীকে অবগত করা হয়েছে।
 
বাংলাদেশি জাহাজ মালিক পক্ষ সম্ভাব্য জলদস্যুপ্রবণ সমুদ্র অঞ্চল জেনেও এই রুটে জাহাজ পরিচালনা করছিল কি না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, না। আমার মনে হয় না। কারণ জাহাজটি চলেছে জলদস্যুদের চলাচল এলাকা থেকে অন্তত ৭০০ নটিক্যাল মাইল দূরে। তবে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর জিয়াউল হক বলেন, যে রুটে জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সেটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি সমুদ্রপথ ছিল। একসময় জাহাজগুলো ওই পথ সবসময় এড়িয়ে চলে।
 
জাহাজটির মালিক এসআর শিপিংয়ের মূল কর্তৃপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, বুধবার সকাল ৭টায় লুকিয়ে এক নাবিক আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তখন তিনি জানান, তারা সুস্থ ও নিরাপদ আছেন।
 
নাবিকদের স্বজনদের ভিড় এসআর শিপিং অফিসে : এদিকে নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড় এলাকায় এসআর শিপিংয়ের অফিসে বুধবার সকাল থেকে ভিড় করেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিক-ক্রুদের পরিবারের সদস্যরা। তারা নাবিকদের দ্রুত নিরাপদে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। এসআর শিপিংয়ের পক্ষ থেকেও তাদের আশ্বাস দেওয়া হয় নিরাপদে ফিরিয়ে আনার। এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমে কর্মীদের কাছে সবশেষ যোগাযোগের সময় নাবিকরা কী কথা বলেছেন তার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
 
জাহাজে জিম্মি নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা হয় নুরউদ্দিনের সঙ্গে। তখন তাদের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, জাহাজ সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজে ৫০ জলদস্যুর সবার হাতে ছিল অস্ত্র। পরে একটি অডিও বার্তায় নুরউদ্দিন বলেন, ‘ফাইনাল কথা, এখানে টাকা না দিলে একজন একজন করে মেরে ফেলবে বলছে।’
 
এ সময় জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, যেন নুরউদ্দিনসহ সবাইকে সুস্থভাবে ফেরত দেওয়া হয়। আমরা তাদের সুস্থভাবে ফেরত চাই। টাকা-পয়সা, চাকরির দরকার নেই।
 
দুশ্চিন্তা চিফ অফিসারের পরিবারে : এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান। চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকানন এলাকায় তার বাসা। আতিকের শ্বশুর মো. ফরিদ বলেন, আতিক উল্লাহর সবশেষ পাঠানো মেসেজে বলে, ‘সবার মোবাইল ফোন নিয়ে ফেলতেছে। আর যোগাযোগ হবে না। দোয়া করিও।’ এ কথা শোনার পর তার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তায় পড়ে যাই।
 
মুক্তিপণের দাবি সত্য নয় : বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত জলদস্যুদের ৫০ লাখ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবি করার সংবাদ সত্য নয় জানিয়ে মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মুক্তিপণ দাবির বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: