বিএনপি-জামাতের বড় পৃষ্ঠপোষক জাহাঙ্গীর আলম

সময় ট্রিবিউন | ২৩ মে ২০২৩, ০০:১৭

ছবিঃ সংগৃহীত

দলের বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে ওঠার চার মাসের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে পুনরায় গাজীপুরের মেয়র হতে চেয়ে দলকে ‘বিব্রতকর’ অবস্থায় ফেলেছিলেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তবে ঋণখেলাপীর দায়ে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হলে তার মাকে নিজের প্রক্সি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছেন দলের বিপক্ষে। এভাবে দলের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়ায় দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারও হয়েছেন তিনি। বিএনপি-জামাতের সাথে তার সখ্যতা থাকায় নির্বাচনে জয়লাভ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা বলেছেন, জাহাঙ্গীর আলম কখনও আওয়ামী লীগের ছিলেনই না। অসাধু উপায়ে বিভিন্ন জনকে খুশি করে পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু মনে প্রাণে আওয়ামী লীগকে ধারণ করতে পারেননি। জাহাঙ্গীর আলমের বিএনপি, জামাত ও হেফাজত প্রীতির ব্যাপারেও সরাসরি অভিযোগ করেন অনেকেই।

সময় ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জাহাঙ্গীর আলমের বিএনপি ও জামাত পৃষ্ঠপোষকতা করার অনেক তথ্যই ওঠে এসেছে।

জানা যায়, মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রকৃত বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। তার বাবার পেশায় ছিলেন জুট মিলের একজন শ্রমিক। তিনি গাজীপুরের কানাইয়াতে জাহাঙ্গীরের নানার বাড়িতে ঘর জামাই ছিলেন। সেখানেই জাহাঙ্গীর ও তার ছোট ভাই এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জাহাঙ্গীর আলম ছাত্রজীবনে মাদ্রাসা হতে ইফতেদায়ি, দাখিল ও আলিম পাশ করেন। পরে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তবে তখন থেকেই ছাত্রলীগের একটি অংশ তাকে শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছিল।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের মামা শফিকুল ছিলেন বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর ইসলামপুরের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে পরে মামা শফিকুল আলম তাকে নিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে মিন্টু গাজীপুরে প্রচুর জমিজমা কেনার দায়িত্ব দেন শফিকুলকে। পরে তিনি এর সঙ্গে ভাগ্নে জাহাঙ্গীরকে যুক্ত করেন।

ওই সময় এক কারখানা মালিকের জমি কেনার অনেক পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন জাহাঙ্গীর। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে এবং ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘোরাতে থাকেন তিনি। বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর হয়ে জমি সংক্রান্ত কারবার করেও প্রচুর অর্থ আয় করেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীর যতটা না আওয়ামী লীগের লোক তার চেয়েও বেশি বিএনপি-জামাত ও হেফাজতের লোক। হেফাজতের তাণ্ডবের সময় গাজীপুরের শীর্ষ হেফাজত নেতা আব্দুর রহিম আল মাদানী কে রক্ষা করার জন্য তিনি নিজ বাসভবনে আশ্রয় দেন। শুধু তাই নয়, বোর্ড বাজার জামে মসজিদ থেকে যখন আব্দুর রহিম আল মাদানী কে বয়কট করা হয় তখন জাহাঙ্গীর আলম নিজে তাকে নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়ে স্বপদে বহাল করে আসেন। তার প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় আব্দুর রহিম আল মাদানী আর রফিকুল ইসলাম মাদানী রা গাজীপুর শহরে অন্তত পঞ্চাশটি আস্তানা গড়ে তোলেন। প্রতিমাসে জাহাঙ্গীর আলম এই সকল মাদ্রাসার প্রধানদেরকে (যার বিশাল একটা অংশ সরাসরি জামায়েতে ইসলামের রাজনীতিতে জড়িত) আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।

কথিত জাগ্রত কবি মুহিব খান ও জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের আদর্শিক পরামর্শক, তাদের অন্যতম নীতিনির্ধারক, জামাত-শিবিরের বিভিন্ন কর্মশালায় যিনি প্রশিক্ষণ প্রদান কএন, জাতির পিতা ও এদেশের স্বাধীনতায় যার ঘোর আপত্তি সে কথিত জাগ্রত কবি মুহিব খানের সাথেও রয়েছে জাহাঙ্গীর আলমের গভীর সখ্যতা। ২০২০ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ইমাম সম্মেলন আয়োজন করেন মেয়র জাহাঙ্গীর। সে অনুষ্ঠানে মুহিব খানকে বিশেষ অতিথী করা হয় এবং মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথী। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তিকারী ও অসংখ্য রাষ্ট্রবিরোধী কবিতা লেখা এই মুহিব খানকে আতিথী করাকে আওয়ামী রাজনীতির আদর্শের উপর চপোটাঘাত বলেও দাবি করেছিলেন অনেক সিনিয়র নেতাকর্মী।

কথিত জাগ্রত কবি মুহিব খান ও জাহাঙ্গীর আলম

এছারাও, জাহাঙ্গীর আলম সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামীলীগ মনোনীত কাউন্সিলরদের পাশ কাটিয়ে হাতে গুণা দুই একজন বিএনপি ও জামায়েতের কাউন্সিলরদের সাথে নিয়ে চলাফেরা করতেন বলেও অভিযোগ করেছেন একাধিক সিনিয়র কাউন্সিলর।

২৩ নং ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হতে জঙ্গী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাওলানা মনজুর হোসেন যে কিনা মুফতি হান্নানের সাথে জঙ্গী মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন তার সাথেও রয়েছে মেয়র জাহাঙ্গীরের গভীর সখ্যতা। বঙ্গবন্ধু পরিবার তথা শেখ হাসিনাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যারা বিগত ৪০ বছরে প্রায় ২১ বার হামলা চালিয়েছে, তাদেরই মতাদর্শের একজন এই মঞ্জুর মাওলানা।

হেফাজত নেতা আবদুর রহিম আল মাদানি ও জাহাঙ্গীর আলম

মেয়র জাহাঙ্গীর এই মঞ্জুর মওলানা কে গণভবন ও বঙ্গভবন পর্যন্তও নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রপতির সাথে তার বিশেষ সাক্ষাৎ হয়েছে এবং তার ছবি তার ২৩ নং কাউন্সিলর কার্যালয়ে টাঙানো ছিল। এই ব্যক্তিকে শুধু সুযোগ-সুবিধাই দেননি তার আপন বড় ভাই কে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও তাকে সদস্যও করেছেন এই জাহাঙ্গীর।

এছাড়াও জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির সাবেক মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানের অন্তত ২০ জন আত্মীয়স্বজনকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা, কৃষক লীগের নেতা, শ্রমিক লীগের নেতা অথচ তারা প্রত্যেকেই গত সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের নির্বাচন করেছে।

মেয়র থাকাকালীন সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদে শত শত চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ দেন তিনি। যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই বিএনপি-জামাত মতাদর্শের এবং অনেকেই সরাসরি বিএনপি বা জামাতের রাজনীতির সাথে জড়িত।

এছাড়াও, 'জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন' নাম দিয়ে গড়ে তোলেন দাতব্য সংস্থা ও বড় লাঠিয়াল বাহিনী। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডেই তাদের কার্যক্রম রয়েছে। এই ব্যানারে কাজ করা পাঁচ শতাধিক ছেলেমেয়েকে সিটি করপোরেশন থেকে বেতন দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও নেওয়া হতো না। জাহাঙ্গীরের নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরতেই ওই ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করা হয়।

 


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: