আজ ৫ মে, শাপলা চত্বরে হেফাজতকাণ্ডের ৮ বছর

সময় ট্রিবিউন | ৫ মে ২০২১, ১৯:৩২

শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম। ছবি: ফাইল

আজ ৫ মে। দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় পরিণত হওয়া হেফাজতের সেই তাণ্ডবের আট বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তখন শাহবাগ উত্তাল। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষ। ওই বছরের ৫ মে ব্লগার, নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষীদের অপতৎপরতা ও প্রচারণা বন্ধ এবং তাদের শাস্তির দাবি নিয়ে হঠাৎ আলোচনায় আসে কওমি মাদরাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম নামের অরাজনৈতিক দাবি করা একটি সংগঠন। তারা রাজধানী ঢাকার ছয়টি প্রবেশপথ অবরোধ করে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল এক সমাবেশও করে। দিনভর অবস্থানের পাশাপাশি চলে ভাঙচুর, শত শত স্থাপনায় করা হয় অগ্নিসংযোগ। দিনব্যাপী দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় হেফাজতের সেদিনের তাণ্ডব।

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের সেই সমাবেশ থেকেই হেফাজতে ইসলাম সারাদেশে আলোচিত। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শাহ আহমদ শফী নিজেই নানা সময়ে নানা বিবৃতি-বক্তব্য দিয়ে এসেছেন আলোচনায়। সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতা করে ফের দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই সংগঠনটি। এসব বিরোধিতার জের ধরে পরিচালিত বিক্ষোভ-সহিংস কর্মকাণ্ডে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব সহিংসতার অন্যতম উসকানিদাতা হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হক আবার ব্যক্তিজীবনের কেলেঙ্কারি নিয়েও আলোচনায়। তিনিসহ হেফাজতের শীর্ষ ২০ থেকে ২৫ নেতা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

সাম্প্রতিক নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা মামলার পাশাপাশি তাদের বেশিরভাগই ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের সেই তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা অর্ধশত মামলারও অনেকগুলোরই আসামি। আট বছর আগের ওই মামলাতেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের। বলা যায়, আট বছর পর এসে শাপলা চত্বরকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো গতি পেয়েছে।

কী ঘটেছিল ২০১৩র ৫ মে

আট বছর আগের এই দিনে আগের ঘোষণা অনুযায়ী ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচি পালন করতে ভোর ৫টা থেকেই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী, কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ তৈরি করেন তারা। ওই সময় থেকেই সারাদেশের বিভিন্ন কাওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা রাজধানীর শাপলা চত্বরে এসে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে শাপলা চত্বর এলাকার পুরোটা দখলে নিয়ে নেন তারা। তবে কেবল সমবেত হওয়ার মধ্যেই সেদিন সীমাবদ্ধ থাকেননি হেফাজতের নেতাকর্মীরা। জিপিও, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়, হাউজ বিল্ডিং ভবন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন পুল, মুক্তি ভবনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও ফুটপাথের দোকানপাটে অংগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় তারা।

দিনভর হেফাজতের নেতারা তাদের বক্তৃতায় সরকারকে আল্টিমেটাম দিতে থাকেন। ওই দিন বিকেলে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সে সংবাদ সম্মেলনে হেফজতে ইসলামকে বিকেল ৫টার মধ্যে কর্মসূচি শেষ করে ঢাকা ছাড়ার পাল্টা আল্টিমেটাম দেন। হেফাজত নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন এবং ভবিষ্যতে আপনাদের আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।’

সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পরপরই শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেন হেফাজতের নেতারা। মাইকে উচ্চস্বরে এক নেতা বলেন, ‘আমাদের সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা ছাড়তে বলেছেন, আপনাদেরই ঢাকা ছাড়তে হবে।’ সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতে থাকলেও শাপলা চত্বরে অবস্থান অব্যাহত রাখে হেফাজতে ইসলাম। রাত সাড়ে ১০টার দিকে হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফী লালবাগ মাদরাসা থেকে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেন। তবে পথে অসুস্থ বোধ করায় ও নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলে তিনি ফিরে যান।

এর মধ্যে দিবাগত রাত ১টার দিকে অবস্থানরত হেফাজত নেতাকর্মীদের সরাতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা ও বঙ্গভবনের দিকে যাওয়ার রাস্তা খোলা রেখে দৈনিক বাংলা মোড়, দিলকুশা, ফকিরাপুল ও নটরডেম কলেজের সামনে অবস্থান নেন পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। তারা হেফাজতের নেতাকর্মীদের শাপলা চত্বর ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সে কথা মানেননি হেফাজতের নেতাকর্মীরা। রাত পৌনে ৩টার দিকে শুরু হয় মূল অভিযান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়তে ছুঁড়তে হেফাজতের তৈরি মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। এরপর আর হেফাজতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। তারা যে যার মতো শাপলা চত্বরের সমাবেশস্থল ছেড়ে চলে যান। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অনেকেই মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেন। পরে পুলিশই তাদের সেসব ভবন থেকে বের করে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় বলে সে সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ভোর ৫টা নাগাদ আগের ২৪ ঘণ্টার তাণ্ডবের চিহ্ন নিয়ে সুনসান হয়ে পড়ে শাপলা চত্বর।

২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নাশকতার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের যারা জড়িত ছিলেন প্রায় ২৫ জনের মতো কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম।

তিনি বলেন, ৫ মে শাপলা চত্বরে নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের ওইসব মামলাতে সকলকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি নাশকতার মামলাতেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নাশকতায় কার কি ভূমিকা ছিল সেটাও আদালতে জবানবন্দিতে অনেকে জানিয়েছেন। যদিও মামলা অনেকদিন হয়েছে। এরপরও আমরা এ বছরের মধ্যেই সকল মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে হেফাজতের বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেন, ২০১৩ সালের মামলা পুনরুজ্জীবিত করে সরকার যে হেফাজতকে ঘায়েল করবে তা বোঝার উপায় ছিল না। মামলাগুলো ছিল ঢাল। নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনের চাহিদাও অনেকটা দায়ী। আমরা চেষ্টা করছি বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন করে ঘুরে দাড়ানোর। হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয় সুতরাং রাজনীতি যেন না হয় সেদিকটা লক্ষ রাখা হবে।

কোণঠাসা হেফাজত

সাম্প্রতিক ঘটনাবলির চাপে অবশ্য হেফাজতে ইসলাম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোকে কেন্দ্র করে যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে হেফাজত, তাতে ফের তাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে শতাধিক মামলা হয়েছে। গত মাসখানেক সময়ে যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় ২০ থেকে ২৫ জন নেতা গ্রেফতার হলে সংগঠনটি বিপাকে পড়ে।

এর মধ্যে, গত ২৫ এপ্রিল রাতে আচমকা সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন আমিরের দায়িত্বে থাকা জুনায়েদ বাবুনগরী। ঘণ্টা চারেকের ব্যবধানে অবশ্য হেফাজতের নতুন আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়। সাম্প্রতিক এসব পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সংগঠনের নেতারা। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তারা। গত রাতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত নেতারা দেখা করেছেন। পরে তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, গ্রেফতার নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ হয়রানি থেকে মুক্ত রাখার আবেদন তারা রেখেছেন মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন নেতাকর্মীদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: