মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর কত দূর?

সাদিয়া হুমায়রা | ২৬ মার্চ ২০২২, ০৯:১৫

ছবিঃ সংগৃহীত

আজকের রাতটি কত শান্ত ও স্নিগ্ধ। কিন্তু ৫১ বছর আগের ২৫ মার্চের রাতটি এমন শান্ত ও নিরুপদ্রব ছিল না। ঢাকাবাসীর জীবনে রাতটি এসেছিল মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন চিরতরে দমন করবার উদ্দেশ্যে বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার জন্য সেদিন পাকিস্তানি সেনারা “অপারেশন সার্চলাইট” নামে একটি সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করেছিল যাতে নিহত হয় অন্তত ৫০ হাজার নিরস্ত্র, সাধারণ নাগরিক। সে রাতে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল তা জারি থাকে পরবর্তী ৯ মাসজুড়ে সারা বাংলায়। “মানুষ চাই না, মাটি চাই” নীতিতে পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টাতে নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে হত্যা করে বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ, ২ লক্ষাধিক নারী ধর্ষণের শিকার হন। বাংলার বুকে সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও একাত্তরে বাঙালির উপর সংঘটিত গণহত্যা বা জেনোসাইডের স্বীকৃতি জাতিসংঘ বা বিদেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ বিবিধ কারণে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিত ও সচেতনভাবে জাতিবিদ্বেষের আধারে একাত্তরে বাঙালি জাতিকে নির্মূলের চেষ্টা করেছিল যা জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশনে দেওয়া জেনোসাইডের সংজ্ঞার সঙ্গে হুবুহু মিলে যায়। তাই মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বিশ্বাস করেন, সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অবশ্যই জাতিসংঘ থেকে একাত্তরের বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি লাভ সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য আনন্দের খবর হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের যাত্রাপথে এ বছর দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি লাভ করা সম্ভব হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে 'জেনোসাইড' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেনোসাইড বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এবং ফেব্রুয়ারিতে স্বীকৃতি দিয়েছে আরেকটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। এই প্রাথমিক অর্জনকে পুর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এখন সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। বিশ্বব্যাপী একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ে তুমুল প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়।

একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য একাধিক কারণে অত্যন্ত জরুরী। দীর্ঘদিন স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকায় খোদ বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অস্বীকারের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য বিকৃতির এক মহামারী প্রচলিত হয়েছে দেশে। মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন বা কতজন নারী সম্ভ্রমহানির শিকার হয়েছেন এ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে সচেতনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তদন্ত কার্যে নিয়োজিত হামুদুর রহমান কমিশন যুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজারে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এছাড়াও শর্মিলা বসুর মতো তথাকথিত গবেষকরা প্রায়শই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে সংখ্যার রাজনীতি করে থাকেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির উপর সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এই সংখ্যার রাজনীতি বন্ধে সহায়ক হবে।

এছাড়া বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ভারতের পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে থাকে। এই অপরাজনীতি বিরুদ্ধে মোক্ষম জবাব হয়ে দাঁড়াবে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে প্রাপ্ত জেনোসাইডের স্বীকৃতি।

জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবির পেছনে এসব রাজনৈতিক কারণের বাইরেও একটি মানবিক কারণ রয়েছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন এ বিষয়ে চমৎকার বলেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টিতে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, গণহত্যা এবং মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের প্রসঙ্গটি আড়ালে পড়ে যায়। এতে ইতিহাসে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। ইতিহাসের এই ভারসাম্যহীনতা দূর করার স্বার্থেই গণহত্যার বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন।

এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার আসলেই সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল আহত-নিহতের পরিসংখ্যানের মতো কাঠখোট্টা বিষয় নয়, নয় কেবল বিজয়ের উল্লাস কিংবা বিভিন্ন সেক্টরে সামরিক বাহিনীর বীরত্বের উদাহরণ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যদি কোনো উপন্যাস হয়, তাহলে তার পাতায় পাতায় রয়েছে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ, স্বপ্নভঙ্গ আর চোখের জলের গল্প। জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা আর ত্যাগ-তিতিক্ষার স্বীকৃতি হয়ে আসবে।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশ উল্টো দিকে চলতে শুরু করে। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ক্ষমতায়নের ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে রাষ্ট্র অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সে রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও এক প্রকার নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি অর্জন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কোনো কিছুই আর আলোর মুখ দেখেনি।

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়, সরকার প্রধান হিসেবে আছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার শাসনামলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে, আমরা এখন ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছি। এ সময় যদি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব না হয় তাহলে হয়তো আর কখনোই সম্ভব হবে না। যদিও জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাই ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগটি সম্ভবত আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু বাঙালির ওপর দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের পথ কখনোই রুদ্ধ হয়নি এবং এ ব্যাপারে আর গাফিলতি করার কোনো অবকাশ নেই।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে অবশ্য বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের পথ খুব সহজ নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল বৈরী এবং অমানবিক। অধিকাংশ মুসলিম দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। গণহত্যার স্বীকৃতির প্রসঙ্গ উঠে এলে সেসব দেশের তৎকালীন ভূমিকার কথাও উঠে আসে, ফলে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ঔদাসীন্য দেখা যায়। কিন্তু এতে সরকারের দমে গেলে চলবে না, বরং কৌশলী কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করতে হবে। কারণ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অত্যন্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, যতদিন পর্যন্ত না একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় হয় ততদিন পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত একটি অনুবিভাগ খুলে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোধগম্য করে ইংরেজিতে একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ক বেশি বেশি মানসম্মত গবেষণাও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দ্বার উন্মোচনে সহায়তা করবে বলে অনেক গবেষক মনে করেন।

লেখক: সাদিয়া হুমায়রা
ফ্রিল্যান্স লেখক ও সাংবাদিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: