হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও হাবিপ্রবি

মশিউর রহমান | ২০ এপ্রিল ২০২১, ০০:০৯

ছবিঃ সংগৃহীত

হাজী মোহাম্মদ দানেশ (২৭শে জুন ১৯০০ – ২৮ জুন ১৯৮৬) অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের একজন কৃষক নেতা। যিনি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাকে তেভাগা আন্দোলনের 'জনক' হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর নামেই দিনাজপুরে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(হাবিপ্রবি)।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ দিনাজপুর এস.এন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসায় আরাম্ভ করেন। কৃষক, বর্গা চাষী, ভাগ চাষী, ক্রান্তি চাষীদের ওপর জমিদার ও জোতদারের সীমাহীন অত্যাচার দেখে শিশু বয়সে মোহাম্মদ দানেশের মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্র জীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার কল্পে কৃষক আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। আন্দোলনকালে তিনি কারাভোগ করেন। নীলফামারি জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ।

হাবিপ্রবি ক্যাম্পাস এর পাশেই ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়ক অবস্থিত ৷ দিনাজপুর শহর হতে ক্যাম্পাস এর দূরত্ব মাত্র ১০ কি.মি.। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সবুজ গাছপালার সমারোহ। আছে লাল-সাদা ইটের দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল ভবন, আছে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার, জিমন্যাশিয়াম, টিএসসি, ক্যান্টিন আছে।

অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ৫টি অ্যাকাডেমিক ভবন, একটি প্রশাসনিক ভবন, ৫টি ছাত্র হোস্টেল(একটি বিদেশী শিক্ষার্থীদের), ৩টি ছাত্রী হোস্টেল, আধুনিক সাজসজ্জা বিশিষ্ট ১০০ আসনের একটি ভিআইপি সেমিনার কক্ষ, ৬০০ ও ২৫০ আসন বিশিষ্ট আরও দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটরিয়াম। এছাড়াও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ করতে রয়েছে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্লাব,২টি মসজিদ, ১৩৬টি আবাসিক ইউনিট/ভবন,১টি শিশুপার্ক, পোষ্ট অফিস, রূপালী ব্যাংক শাখা, মেঘনা ব্যাংক শাখা, শ্রমিক ব্যারাক, সার্বাক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধা, নিজস্ব বৈদ্যুতিক লাইন,বৃহৎ খেলার মাঠ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সমন্বয় ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (আই.আর.টি.)। আছে একটি ভি. আই. পি গেস্ট হাউস, হাবিপ্রবি স্কুল, ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেন্সসহ ১২ শয্যার একটি মেডিক্যাল সেন্টারও(বর্তমানে তা বাড়ানোর কাজ চলছে) । গবেষণালব্ধ থিসিস, রিপোর্ট, জার্নালের পাশাপাশি রয়েছে ২৫ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির আকর্ষণীয় সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বিভিন্ন বিভাগের তত্ত্বাবধানে গবেষণার জন্য জামপর্স্নাজম সেন্টার।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়। প্রতি সেমিস্টার সমাপ্ত হয় ২১ সপ্তাহে। যেখানে ইংরেজি মাধ্যমে ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। পাশাপাশি বাস্তব জ্ঞান অর্জনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষা সফর। মেধাবীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন পদক ও বৃত্তির ব্যবস্থা। একাডেমিক কার্যক্রম বছরে ২টি সেমিস্টারে ক্রেডিট পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদের অধীন ২৩টি স্নাতক ডিগ্রী এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট অনুষদের অধীন ৩২টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান করে। দিনাজপুর সদরের বাঁশেরহাট নামক স্থানে অবস্থিত একটি সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ২য় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এটি উত্তর বাংলার সেরা বিদ্যাপীঠ যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন এই বিদ্যাপীঠে।

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উন্মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীন জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবথেকে বড় কাজ হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে কার্যকরী দৃশ্যমান বা অবস্থানগত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে হাবিপ্রবিতে প্রায় বার হাজার শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেদের মেধা দিয়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে শক্তিশালীভাবে দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটগন নিজেদের মেধা দিয়ে দেশের সকল স্তরে দক্ষতার সাথে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা সাক্ষর রাখছে সিভিল সার্ভিস থেকে শুরু করে সকল স্তরে। ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয় আরো বেশি আলোকিত মানুষ তৈরি করবে এই প্রত্যাশা সকলের। হাজী মোহাম্মদ দানেশের জন্মভুমি, তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিভুমি, রুটির ঝুড়ি দিনাজপুরের বুকে সর্বোপরি বাংলাদেশের বুকে এই বিশ্ববিদ্যালয় এক আশ্চর্যের নাম হবে এই আশা।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: