ফরিদপুরে চক্ষু হাসপাতালের সামনে চশমা দোকানে অসাধু বাণিজ্য, মানুষ ঠকিয়ে  কোটিপতি

স্টাফ রিপোর্টার, ফরিদপুর | ৩ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৮

ফরিদপুরে চক্ষু হাসপাতালের সামনে চশমা দোকানে অসাধু বাণিজ্য, মানুষ ঠকিয়ে  কোটিপতি
ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুর লঞ্চঘাটে জহুরুল হক চক্ষু হাসপাতালের গেট সংলগ্ন আই কেয়ার নামে একটি চশমার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে চলছে অসাধু বাণিজ্য! দ্বিগুণ তিনগুণ দাম হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এতে ফুলেফেঁপে উঠেছে তাদের চশমার বাণিজ্য। একইস্থানের অন্য দোকান যেখানে ক্রেতা সংকটে থাকে, সেখানে আই কেয়ারের মালিক একাধিক শোরুম খুলে চশমার রমরমা বাণিজ্য চালাচ্ছে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আসা সহজসরল রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। তাদের নিকট থেকে কয়েকগুণ বেশি মূল্য হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, অসাধু চক্রের যোগসাজশে তারা বছরের পর বছর এই অসাধু কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।
 
ভুক্তভোগী একজন ক্রেতা জানান, আই কেয়ারের মালিক মিজানুর রহমানের নিকট থেকে সরলবিশ্বাসে চশমা কিনে তিনি চরমভাবে প্রতারণার শিকার হন। অথচ তিনি ওই দোকানির নিকট থেকে চশমা কেনার সময় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবহৃত চশমার ফ্রেমটিও তাকে দিয়ে দেন বিনামূল্যে। এখন প্রতারিত হওয়ার পরে তিনি বুঝছেন যে, এরা কাস্টমারকে ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেই সদাব্যস্ত।
 
তিনি বলেন, চশমার জন্য এক নম্বর ব্লু কাট কাঁচ দেয়ার কথা বলে তাকে চীন থেকে আমদানিকৃত একটি মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচ দিয়ে চশমা বানিয়ে দেয়া হয়। দাম রাখা হয় ১৪শ' টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ওই কাঁচের দামই নেয় এক হাজার টাকা। তাকে কোন ভাউচার রশিদও দেয়নি। এর ক'দিন পরে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেলে তিনি বিষয়টি মিজানকে জানান। কোন সুরাহা না করে বরং এতে উল্টো রেগে উঠেন মিজান। এটি প্রায় বছর আগেকার ঘটনা।
 
এরপর গত এক সপ্তাহ আগে পরিচিত এক দোকান থেকে মাত্র সাতশো টাকায় কাঁচ ও ফ্রেম সহ আরেকটি চশমা কিনেন ওই ব্যক্তি। শনিবার দুপুরে তিনি আই কেয়ার নামে ওই দোকানে যেয়ে মিজানকে পেয়ে চশমাটি দেখিয়ে এর দাম জানতে চান।
 
অবশ্য মিজান কৌশলে এড়িয়ে যেয়ে বলেন, তার দোকানে এই ধরনের ফ্রেম নেই তাই দাম কতো তা জানেন না। এরপর তার কাছে ওই চশমার কাঁচের দাম জানতে চাইলে বলেন, পাঁচ-ছয়শো টাকার মতো হবে। তখন ফ্রেম সহ ওই চশমার দাম কতো হতে পারে জানতে চাইলে মিজান জানান, দেড় হাজার টাকার কিছু কমবেশি হতে পারে। অথচ গত সপ্তাহে মাত্র সাতশো টাকায় ওই চশমাটি কেনা হয়।
 
হাতেনাতে মিজানের জোচ্চুরি টের পেয়ে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে ওই ব্যক্তি আই কেয়ারের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, "এভাবেই ব্যবসা করছেন? ভালো!" একথা বলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন মিজান। ক্ষিপ্ত হয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকেন, "আমি কি আপনার থেকে ডাকাতি করছি নাকি? নাকি চুরি করছি? আপনি আগেও এমন কথা কইছেন। আমি আপনেরে শেষ কইর‍্যা দিছি? যান যা পারেন কইরেন। মিজান মোল্লার এই আকস্মিক উচ্চবাচ্য শুনে আশেপাশের লোকেরা সেখানে জড়ো হন।
 
এসময় উপস্থিত লোকেরা জানান, মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অনেকেই এমন অভিযোগ করেন। কিন্তু এর কোন প্রতিকার মিলেনা৷ তাদের অভিযোগ, হাসপাতালের অসাধু একটি চক্রের সাথে যোগাযোগ করে সে এককভাবে রোগীদের টার্গেট করে ব্যবসা করছে সেখানে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি দামে সে চশমা বিক্রি করে। আর এভাবে ক্রেতার পকেট হাতিয়ে মাত্র অল্প সময়ে অগাধ সম্পদের মালিক বনে গেছে। 
 
জানা গেছে, মিজানের ভাইয়েরা পরিবহনের চালক, কেউ শ্রমিক। অর্থাভাবে পড়াশুনাও বেশিদুর এগোয়নি তার। এখন এই চশমা ব্যবসার অসাধু কায়দা-কৌশল শিখে নিয়ে রাতারাতি সে এখন প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। একাধিক দোকানসহ পাশেই দশতলা মদিনা টাওয়ারে নিজস্ব ফ্ল্যাট বাসা কিনেছে বলেও জানা গেছে। দিনেদিনে ফুলেফেঁপে উঠেছে তার ব্যবসা ও সহায়সম্পদ। লঞ্চঘাটে পৌরসভার রাস্তার পাশে সরকারি জায়গার পজিশন কিনে পাকা দোকান তুলে নিয়েছে। যার কোন বৈধ অনুমোদন নেই। রাস্তার অপর পাশে আরেকটি দোকান ভাড়া নিয়ে লোক দিয়ে ব্যবসা করাচ্ছে। পাঁচজন কর্মচারী পুষছে সে। তাদের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাবদ তার মাসে লাখ টাকা দেয়। আর দূরদূরান্ত হতে আসা রোগীরা কিছু বলতে গেলে তাদের শায়েস্তা করে এদের দিয়ে। ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না বলে দিনে দিনে ঔদ্ধত্য হয়ে উঠেছে তার আচরণ। এখন সে স্থানীয়দেরও তোয়াজ করেনা।
 
জানা গেছে, বছর পনের আগে লঞ্চঘাট এলাকায় একটি ছোট দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে নিপুণ অপটিক নামে চশমার ব্যবসা শুরু করেন মিজান মোল্লা। তখন তার দোকানে তেমন কাস্টমারও পেতোনা। বেশিরভাগ সময় সে পথচারী কিংবা চা দোকান থেকে লোক ডেকে এনে দোকানে বসিয়ে তাদের সাথে দাবা খেলে সময় কাটাতো। কিন্তু গত বছর পাঁচেক যাবত তার ব্যবসার কৌশল পাল্টে গেছে। রীতিমতো সিন্ডিকেট করে সে এখন লঞ্চঘাট চক্ষু হাসপাতাল এলাকার চশমা ব্যবসায়ীদের বড় একজন হয়ে উঠেছে। এখন সে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মানুষকে ঠকিয়ে টাকা উপার্জনই তার একমাত্র লক্ষ্য।
অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় চক্ষু হাসপাতালে আসা রোগীরা সহ সহজসরল ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। আবার ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরেরও কোন তদারকি দেখা যায়না। 
 
দেখা গেছে, চক্ষু হাসপাতালে নিযুক্ত লোকেরা রোগীদের সরাসরি নিপুণ অপটিকে যেতে বলছে। কোন চক্ষু রোগীকে নতুন চশমা বা চশমা বদলের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হলে তারা রোগীকে মিজানের দোকানে পাঠিয়ে দেয়। আবার হাসপাতাল থেকে রোগীরা বের হলে তাদেরও কখনো ডেকে ডেকে কখনো হাত ধরে মিজানের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়।
 
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিদিন অগণিত রোগীর নিকট থেকে এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতাদের কোন ভাউচার রশিদ দিতে দেখা যায়না। কেউ বলতে গেলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। এ ব্যাপারে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ দাবি করেছেন।
 
এব্যাপারে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান দাবি করেন তিনি কোন চশমা ক্রেতার নিকট থেকে অতিরিক্ত দাম আদায় করেন না এবং ক্রেতাদের ভাউচারও প্রদান করেন। মদিনা টাওয়ারের ফ্লাটটি তার নয় বরং তার বোনের কেনা। বোনের ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করেন। তবে পড়াশোনা কোথায় করেছেন এ প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে যান। মিজান বলেন, আমার বিরুদ্ধে শত্রুতাবশত এসব অভিযোগ করা হয়েছে।
 
স্থানীয়রা জানান, জহুরুল হক চক্ষু হাসপাতালে মাত্র একশো টাকা ফি দিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখানো যায়। অত্রাঞ্চলে চোখের রোগে সাধারণ মানুষের ভরসা এই হাসপাতাল। কিন্তু হাসপাতালে সহজলভ্য চিকিৎসা মিললেও বাইরের এই অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য প্রতারিত হচ্ছেন রোগীরা। আর বর্তমানে মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ায় দিনে দিনে চক্ষু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এব্যাপারে জোরদার তদারকি দাবি করেন তারা।
 

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: