ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেদারসে চলছে অনুমোদনহীন অবৈধ ৯৬ ইটভাটা, হুমকিতে পরিবেশ

গোলাম সারোয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি | ১৬ জানুয়ারী ২০২৪, ১৯:০৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেদারসে চলছে অনুমোদনহীন অবৈধ ৯৬ ইটভাটা, হুমকিতে পরিবেশ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৭৬টি ইটভাটার মধ্যে ৯৬টিই অবৈধ। পরিবেশের ক্ষতি করে চালানো এসব ইটভাটার অধিকাংশই কৃষিজমি, হাটবাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে- যা আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন।

এছাড়াও ইটভাটাগুলোতে নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বায়ু দূষণ হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। সর্বোপরি হুমকির মুখে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, ইটভাটার জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে মজা পুকুর, খাল বা বিল, দিঘি বা নদ-নদী অথবা হাওর বা চরাঞ্চলের পতিত জায়গা থেকে মাটি কাটতে পারবে। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত কয়েকবছর ধরে প্রতি মৌসুমে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কাটা হচ্ছে ইটভাটার জন্য। এর মধ্যে জেলার নবীনগর, সরাইল এবং বিজয়নগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমির মাটি সবচেয়ে বেশি কাটা হচ্ছে। মূলত ভাটার মালিক এবং দালালদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা জমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন ইটভাটায়। এর ফলে ফসলি জমির উর্বরাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় ১৭৬টি ইটভাটার মধ্যে ৯৬টি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ভাটা মালিক পরিবেশ অধিদপ্তরের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। মূলত জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকা, অননুমোদিত জায়গায় ভাটা স্থাপন এবং ইট পোড়ানোর পদ্ধতি সঠিক না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে কোনো একটি ইটভাটাকে অবৈধ ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়াও ইটভাটা স্থাপনের জন্য কয়েকটি দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তবে অবৈধ ৯৬টি ইটভাটার মধ্যে ৫০টিরও বেশি ভাটার কার্যক্রম এখনও চলছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল, নাসিরনগর ও বিজয়নগর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে কৃষিজমির পাশে এবং কষিজমির মাঝখানে। এসব ইটভাটাগুলোর এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে জনবসতি রয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাতেও রয়েছে কয়েকটি ইটভাটা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার রামপুর এলাকার ডিজিটাল ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী মো. বাবুল মিয়া বলেন, আইন মানতে গেলে জেলায় ১০টির বেশি ইটভাটা থাকবে না। তখন মানুষ আর ইট পাবে না। ইট প্রস্তুতের জন্য কিছু নিচু জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। যেসব জমিতে ফসল হচ্ছে না সেগুলোর মাটি কাটা হচ্ছে। আর এখন কৃষকরাও সচেতন। যেগুলো টিলা হয়ে গেছে, ফসল হচ্ছে না- সেগুলোর মাটি কাটা হচ্ছে। আর মানুষ এখন ধীরে ধীরে ব্লকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যদিও পুরোপুরিভাবে ব্লকের ব্যবহার হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে- উল্লেখ করেন বাবুল মিয়া।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও জেলা ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, অনেক ইটভাটা আছে যেগুলো ১০ বা ১৫ বছর আগে হয়েছে। তখন সেখানে কোনো স্কুল বা মানুষের বসতি ছিল না। এখন সেই ইটভাটার পাশে স্কুল হয়েছে। সেগুলোতো ইচ্ছা করলেই বন্ধ করে দেওয়া যাচ্ছে না। সরাসরি যদি মানুষের ক্ষতি না করে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। তবে ইতোমধ্যে স্কুলের পাশে থাকা অনেকগুলো ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লকের ব্যবহার পুরোপুরিভাবে শুরু হলে এমনিতেই অনেক ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাবে।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করে- এমন সংগঠনগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বছরের পর বছর ধরে বহু অনুমোদনহীন ইটভাটা পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেই পরিবেশ ও ফসলি জমির ক্ষতি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ইটভাটা মালিকরা। ইট প্রস্তুতের মৌসুম শুরুর আগে ইটভাটা মালিকরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তরী বাংলাদেশ সংগঠনের সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, সুস্থ পরিবেশের জন্য ইটভাটাগুলো এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ আইন অমান্য এবং ছাড়পত্র না থাকায় জরিমানা করতে দেখা গেলেও ইটভাটা বন্ধ করা বা ধ্বংস করার নজির নেই বললেই চলে। মূলত প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে নির্বিঘ্নে চলছে অবৈধ ইটভাটাগুলো। তাই প্রশাসন তৎপর না হলে এগুলো চলতেই থাকবে এবং পরিবেশের ক্ষতি করবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খালেদ হাসান বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি ২০১৩ সালে করা হয়েছিল। আর আইনটি বাস্তবায়ন হয় ২০১৬ সালে। এই সময়ের মধ্যে অনেক স্থানে কৃষিজমি এবং স্কুলের পাশে ইটভাটা স্থাপন করে ফেলেন মালিকরা। ফলে এগুলো হুট করে আমরা বন্ধ করে দিতে পারছি না। তবে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলে। গত বছর (২০২৩ সাল) ইটভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়ে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা হয়। কয়েকটি ইটভাটা বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের জন্য অভিযান স্থগিত ছিল। আমরা আবারও অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নামব।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: