কর্মী সংকটে বাম সংগঠনগুলো, যা বলছেন নেতারা

রাবি সংবাদদাতা | ৬ জুলাই ২০২২, ০৯:০৪

সংগৃহীত

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বরাবরই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বাধীনতার পূর্ববতী ও পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংগঠনগুলো রয়েছে গৌরব উজ্জ¦ল ইতিহাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে ছিল না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনগুলো। তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছিল স্বর্ত¯ফূর্ত অংশগ্রহণ। তবে বর্তমানে ক্যাম্পাসে সেই চিত্র নেই বললেই চলে।

 সাধারণ শিক্ষার্থী তো দূরে থাক খোদ কর্মী সংকটে পড়ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। কোনো কোনো ছাত্র সংগঠন কেবল সভাপতি-সম্পাদক নির্ভর, নেই কোনো কর্মী। আবার কোনো সংগঠনে কর্মী থাকলেও ৪-৫ জনে মধ্যে সীমাবদ্ধ। কর্মী সংকটের জন্য ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য, ভিন্নমতে ছাত্রদের ওপর দমনপীড়ন ও করোনাকালে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকাকে দায়ী করেছেন বাম ছাত্র সংগঠনের নেতারা। 

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর এক আধিপত্য ছিল। ভর্তি ফী কমানো, সান্ধ্য আইন বাতিল, সান্ধ্যকোর্স বাতিলসহ সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে তাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। কিন্তু সেসব আজ ইতিহাস। ক্যাম্পাসে বর্তমানে ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই ছাত্র সংগঠনগুলো কাগজে কলমে জোটে না থাকলেও বিভিন্ন ইস্যুতে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে। যেখানে চার বছর আগে জোটের কর্মসূচিতে ২৫-৩০ নেতাকর্মী দেখা যেত। বর্তমানে তা ডজনের ঘরে ঠেকেছে।

করোনা পরবর্তী সময় ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে ডাকা কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ উল্লেখ যোগ্যহারে কমেছে। ১০-১২ জনের বেশি উপস্থিতি দেখা যায় না। পরিস্থিতি এমন যে কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনে কর্মী নেই। সভাপতি সাধারণ সম্পাদক নির্ভর হয়ে পড়েছে। 

প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোতে কর্মী সংকটের জন্য দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামো দায়ি বলে মনে করেন ছাত্র ফ্রেডারেশনের সাধারণ সম্পাদত মোহাব্বত মিলন। তার দাবি, বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনীতি নেই। এখানে বিগত ১৫ বছর যাবৎ একটি রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করছে। তারা ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সর্বত্র একক আধিপত্য বিস্তার করছে। যার রেশ পড়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোতেও। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন হল থেকে শুরু করে সর্বত্র একক আধিপত্য বিস্তার করেছে। যার কারণে ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে আমাদের মতো প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর পরিধি সংকুচিত হয়ে যায়। তাছাড়া করোনার একটি প্রভাব তো আছেই। যার কারণে আমাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। 

ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টে। সংগঠনের সভাপতি রিদম শাহরিয়াকে ছাড়া অন্য কাউকে ওইভাবে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। কর্মী সংকটের বিষয়ে সভাপতি রিদম শাহরিয়ার বলেন, সমসাময়িক রাজনীতির সাথে বাম রাজনীতির তুলনা করলে ভুল হবে। স্রোতের অনুকূলে গা ভাসালেই গতি পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা স্রোতের প্রতিকূলে আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি করি। নব্বই এর দশকের পরে রাজনীতির গতি কিছুটা মন্থার হয়েছে। এর পরেও আমরা ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলাম। 

তিনি আরো বলেন, সবসময়ই ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন থেকে আমাদের বিভিন্ন বাধায় পড়তে হয়। হল দখলসহ বিভিন্ন শিক্ষার্থী হয়রানি মূলক কাজ আগে ছাত্রদল করত এখন ছাত্রলীগ করে। এই বাধা গুলো পেরিয়ে আমরা আমাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা (কর্মী সংকট দূর করে) বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শাকিলা খাতুন বলেন, আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মতমত প্রকাশ ও সাংস্কৃতি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র ছিল। তখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নিত। সে সময় প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর প্যানেলই সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই দীর্ঘদিন ধরে। এখন মুক্তবুদ্ধির চর্চায় বাঁধা আসে। কেউ মতপ্রকাশ করলে , তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাইলে মারধর করা হয়। এছাড়া হামলা-মামলা হুমকি দেওয়া হয়। যার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনে ভীতি ছড়িয়েছে। 

ছাত্র ইউনিয়নের এই নেত্রী দাবি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের একক আধিপত্য ও মতামত চর্চায় বাঁধা দেওয়ার কারণে ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতিতে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। যেই সংকটের প্রভাব পড়েছে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোতে। যার কারণে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোতে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। শাকিলা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র ফিরে আসলে ক্যাম্পাসগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত চর্চা করতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে কর্মী সংকটও থাকবে না । 

বাম ছাত্ররাজনীতিকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আমিরুল ইসলাম কনক। কর্মী সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যখন যে দল ক্ষমতায় আসছে সেই দলের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস, বিভাগ, হলগুলোয় একক আধিপত্য থাকে। তারা যে ধরণের তৎপরতা চালায় তাতে নতুন শিক্ষাথীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার ঘটে। তারা ওই ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি হতে চায় না। তাছাড়া বর্তমানে সবাই ভোগের রাজনীতিতে আগ্রহী। ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। সবাই সুযোগ সুবিধা চায়। আদর্শের রাজনীতি কেও করতে চায় না। প্রগতিশীল রাজনীতি করতে গেলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এই আদর্শিক জায়গাতে খুব সিলেক্টড ছেলে মেয়ে আসে। প্রগতিশীল রাজনীতি করতে হলে যে মানসিক জোড় থাকা দরকার, যে চর্চা দরকার সে পরিবেশ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। যার কারণে প্রগতিশীল সংগঠনগুলোতে কর্মী সংকট তৈরি হয়েছে।  


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: