'স্বপ্নের পদ্মা সেতু' নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা’

সিয়াম মাহমুদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ | ২৫ জুন ২০২২, ১০:০৯

সংগৃহীত

পদ্মা সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। বেশি দিন আগের কথা না, গত শনিবার আমার আব্বু গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন, মাঝির ঘাটে (মাঝির কান্দি) এসে শুনে ফেরি চলবে না। বৃষ্টি হচ্ছে, নদীতে প্রবল স্রোত। সেখানে এক এম্বুলেন্সের গাড়ি ছিল, রোগীর পরিবার নাকি অসহায়ের মতো বলেছিলেন, আল্লাহর নাম বলে ফেরিটা ছাড়েন, আল্লাহ যা করবে দেখা যাবে। এমন ছোট ছোট অনেক কাহিনী নদীর সাথে জড়িয়ে আছে, বললে হয়তো শেষ হবে না। পদ্মা সেতু চালু হলে রোগী যাতায়াতের সমস্যাগুলো দূর হবে, সাথে যাতায়াতের সময়ও কমে আসবে এবং কমে আসবে জীবনের ঝুঁকি। বলছিলেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী পদ্মা পাড়ের মেয়ে লামিয়া আক্তার তাজিন, নদী পারাপার নিয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এমন হাজারও দুঃখ-কষ্টের স্মৃতি রয়েছে এই প্রমত্তা পদ্মা নদীকে নিয়ে।

এই পদ্মা সেতু নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হাজারও আশা আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে কতোশত স্বপ্ন। অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনা দূর করে, হাজারও বাঁধা বিপত্তি আর ষড়যন্ত্র কাটিয়ে আগামী ২৫জুন শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু। 

পদ্মা সেতুর শুরুটা হয়েছিলো ২০০১ সালের ০৪ জুলাই। যদিও ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বপ্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প। এটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি স্বপ্ন হিসেবে চিত্রিত বা রূপায়িত হয়েছিল। এই স্বপ্নের রূপকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে এবং তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন ২৯ জুন ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে এবং অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীও সরে দাঁড়ায় তখন ওই বছরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাবের বাস্তব রূপায়ণই আজকের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শান্ত ঘোষ বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের মতো ভ্রমণ পিপাসু শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোবাসার জায়গা। কতোবার ফেরী পার হয়ে পদ্মা নদী ভ্রমণ করেছি। কিন্তু আনন্দের সাথে সাথে ফেরীতে দীর্ঘ অপেক্ষার ভোগান্তি আর উত্তাল ঢেউয়ের মৃত্যুঝুকি নিয়ে পার হয়েছি। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে, সেই দীর্ঘ সময় নষ্ট হবে না এবং দূর্ঘটনার ঝুঁকিটাও কমে আসবে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, এখানে যেন পদ্মা সেতুকে ঘিরে একটি পর্যটন শিল্প নগরী গড়ে তোলা হয়, এতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।

অধ্যাপক আবদুল মজিদ কলেজের শিক্ষার্থী শেখ ফেরদৌস ফাহিম বলেন, আমার কাছে পদ্মা সেতু মানে একটা আবেগ, কেননা আমি সেই পদ্মা নদীর রাগান্বিত উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে এপারে এসেছি। কতোবার দেখেছি মা তার সন্তানকে বুকে আগলে ধরে আল্লাহর নাম নিচ্ছে আর লঞ্চটি কখন ঘাটে পৌঁছবে সেই প্রহর গুনছেন। আবার গাবতলি থেকে গাড়িতে উঠে রাত ৯টায় ঘাটে গিয়ে পৌঁছাই কিন্তু ঘাটে জ্যাম থাকার কারণে সারা রাত ঘাটেই থাকতে হয় ফেরিতে উঠতে হয় প্রায় ৮ ঘন্টা পরে মানে পরের দিন সকালে। তাই, পদ্মায় যারা পারাপার করেছে, তারাই বুঝবে এই পদ্মা সেতু আসলে কি? কোটি টাকার একটা সেতু কতো মানুষের ছোট ছোট স্বপ্নকে বাঁচিয়ে দেবে, কতো মুমূর্ষু রোগী কে প্রান ফিরিয়ে দেবে, ব্যবসা বানিজ্যের উন্নতি ঘটাবে।

আজ পদ্মা পাড়ের মানুষের ঈদ স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো। এই দিনটি বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের মুহূর্ত।

তিতুমীর কলেজের ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ফারিনা আক্তার নদী বলেন, পদ্মা পাড়ের মানুষ হিসেবে এটি আমাদের স্বপ্নের সেতু। একসময় আমাদেরকে ফেরী দিয়ে নদী পার হয়ে বাড়ি যেতে প্রায় ৮-১০ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হতো। এখন পদ্মা চালু হলে হয়তো সেটি ৪-৫ ঘন্টা কমে আসবে। তাছাড়া ঈদের সময় তো কখনো কখনো ১দিন সময় লাগতো, পাশাপাশি দূর্ঘটনার ঝুঁকি ছিলো মারাত্মক। এখন সেই সবকিছু ভোগান্তি ও সমস্যা পেরিয়ে খুব সহজেই বাড়ি যেতে পারবো, এটি খুবই আনন্দের।

তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবু আবদুল্লাহ মোঃ গালিব বলেন, স্বপ্ন পূরণ এর দ্বারপ্রান্তে আমরা। এইতো আর অল্প কিছুক্ষন তারপরই স্বপ্ন পূরণ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে যেন ঘোষণা দিচ্ছে বাংলাদেশ পারে। সে পারে অজয়কে জয় করতে। এই একটি সেতু যা শুধু সেতু নয়, একটি আবেগ, একটি ভরসা, একটি স্বপ্ন যা আজ সত্যি। পদ্মার ওপার এর মানুষ জানে এর মর্ম। সময়মত মা কে নিয়ে হাসপাতালে পৌছাতে না পারা সন্তান, অল্প কিছু সময় পর এ গিয়ে সোনার হরিণ সরকারি চাকরি পরীক্ষায় বসতে না পারা বেকার শিক্ষার্থী আর প্রমত্তা পদ্মায় নিজের যক্ষের ধন সন্তানকে হারানো রহিমা বেগম জানেন এই পদ্মা সেতু কি?!

দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন থেকে শুরু করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধির বিকাশে পদ্মা সেতু সহায়ক হবে। পদ্মা সেতুর বড় দিক হলো মধ্যপশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ফেরি পারাপারের দীর্ঘ সময় অপচয় ও ভোগান্তির অবসান। এর অর্থনৈতিক উপযোগ হচ্ছে কর্মমুখী যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের সময়, জ্বালানি খরচ, শ্রমঘণ্টা সাশ্রয়। এ অঞ্চলকেন্দ্রিক কাঁচা ও পচনশীল কৃষি ফলন ও মৎস্য অর্থনীতিকে গতিশীল করবে পদ্মা সেতু।দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এই সেতু। যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। ২০০৫ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালু হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

বিনিয়োগের দিক থেকে দক্ষিণাঞ্চলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব। বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রপ্তানি হয়। এসব পণ্যবাহী ট্রাককে যমুনা সেতু ঘুরে কিংবা মাওয়া ফেরি দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, বেনাপোল থেকে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় আসতে এখন ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা লাগে। পদ্মা সেতু হলে ৬-৭ ঘণ্টায় পণ্য পরিবহন করা যাবে। এতে আমদানি-রপ্তানিতে খরচ ও সময় বাঁচবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, পদ্মার ওপারের ২১টি জেলায় ১৩৩টি উপজেলা আছে। এর মধ্যে ৫৩টি উপজেলা উচ্চ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। এসব উপজেলার মধ্যে ২৯টি বরিশাল বিভাগে। এ ছাড়া ৪২টি উপজেলা মধ্যম দারিদ্র্য এবং ৩৮টি নিম্ন দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। সেতু চালুর পর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে দ্রুত ওই এলাকার মানুষের আয় বেড়ে দারিদ্র্য বিমোচন হবে।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: