'স্যার' না ডাকলে মনোক্ষুণ্ণ হন জাবি কর্মকর্তারা, সেবা প্রদানে অসহযোগিতার অভিযোগ

মান্নান, জাবি প্রতিনিধি | ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ০১:৫২

ছবিঃ সংগৃহীত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফিসের কতিপয় কর্মকর্তারা ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে চান এবং স্যার না ডাকলে মনোক্ষুণ্ণ হন বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ রয়েছে। শিক্ষক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাই বলে সম্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি অফিসের কর্মকর্তারা তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে নানাভাবে চাপ দেন। ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে শিক্ষার্থীদের সাথে অসহযোগিতামূলক আচরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়, রেজিস্ট্রার কার্যালয়সহ কয়েকটি জায়গার কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের সেবা প্রদানে অসহযোগিতামূলক আচরণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় কাজে রেজিস্ট্রার অফিস ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের ভাই সম্বোধন করলে তারা সেবা দিতে অসহযোগিতা করেন। অনেক সময় রেগে গিয়ে খারাপ ব্যবহারও করেন এবং স্যার ডাকতে পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে ক্যাম্পাসে নবাগত প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সাথে এমন ঘটনা বেশি ঘটে।

এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাস করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীরত অনেক কর্মকর্তাই শিক্ষার্থীদের 'তুমি' বলে সম্বোধন করে থাকেন বলে জানা গেছে। যদিও অফিসিয়াল কাজে কোন শিক্ষার্থী গেলে তাকে 'তুমি' সম্বোধন করার সুযোগ নেই কর্মকর্তাদের। এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকলে ক্যাম্পাসে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোন শিক্ষার্থীও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সেবা প্রদানের সময় 'তুমি' সম্বোধন করার সুযোগ নেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ ডাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজীম উদ্দিন বলেন, “‘স্যার’ বলার বিষয়টিকে কে কীভাবে নেয়—এটাই হচ্ছে বিষয়। শুধু শিক্ষক হলেই যে তিনি ‘স্যার’ হবেন বিষয়টাকে এভাবে বুঝলে আমি মনে করি এখানে বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে। একজন শিক্ষার্থী যখন এখানে পড়াশোনা শেষ করে কোনো অফিসে চাকরি নিতে যাবেন, তখন তিনি কিন্তু সেই অফিসের ক্লার্ককেও ‘স্যার’ বলবেন।”

কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ সম্বোধনের পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে চাইতেই পারেন। একজন ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাস বা অনার্স পাস শিক্ষার্থী একজন ডেপুটি বা অ্যাসিসস্ট্যান্ট কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলতে সমস্যা কোথায়? এই শিক্ষার্থীরাই তো মাস্টার্স পাস করে তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য হাজারখানেক ইন্টারভিউ দেবে। তাহলে এখানে কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলতে তার ইগোতে লাগবে কেন?

এ বিষয়ে জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাকিবুল রনি বলেন, "স্যার সম্বোধনকে সম্মান প্রদর্শনের একমাত্র উপায় ভাবা এবং এই সম্বোধন না করা হলে অপমানিত বোধ করার প্রবণতা নিঃসন্দেহে কলোনিয়াল হ্যাংওভার। তদোপরি জোর করে কিংবা বাধ্য করে নিজে চেয়ে আদায় করার বস্তু তো সম্মান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের উচিৎ এই ধরণের কলোনিয়াল এবং অদ্ভূত মানসিকতা থেকে বের হয়ে যথাযথভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। সেটা করলেই নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীরা তাদেরকে প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করতে কার্পণ্য করবে না।"

জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, "সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।আমাদের সংবিধানের জনগণের সার্বভৌমত্ব, সুপ্রিমেসি এবং অধিকার উচ্চকিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এ দেশে জনগণের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একমাত্র ছাত্র ও শিক্ষক ছাড়া আর কাউকে অফিস বা অন্যত্র সবখানে সবাইকে স্যার বলার রীতি তুলে ফেলা উচিৎ বলে মনে করি। যাদের স্যার না বললে রাগ হয় তাদের মানসিক সমস্যা আছে।আমারা ছাত্ররা সাধারণত বিভিন্ন দরকারে তাদের কাছে যাই এটা বুঝতে পেরেই তারা সুপ্রিমেসি খাটানোর চেষ্টা করে। এটা তাদের মানসিক সমস্যা।"

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ফরিদ আহমদ বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কাকে কিভাবে সম্বোধন করবে সেটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কাউকে স্যার' সম্বোধন করার জন্য চাপ প্রয়োগের সুযোগ নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের কোন কর্মকর্তা এরকম আচরণ করছে এ মর্মে কোন শিক্ষার্থী অভিযোগ করলে আমি বিষয়টি দেখবো। এ বিষয়টি আমি আগে জানতামনা। গতকালই শুনলাম। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে অনেক পরিবর্তন সাধন করেছি। শিক্ষার্থীরা যাতে সহজে সেবা পায় সে ব্যবস্হা করেছি। 'স্যার' সম্বোধন নিয়ে এরকম ঘটনা ঘটলে আমাকে জানাতে হবে। এ বিষয়ে আমি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবো।"

জাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কর্মকর্তাকে স্যার ডাকার নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরকেই স্যার বলে সম্বোধন করা হয়। বাকি যারা আছেন তাদের সম্পর্কের জায়গা থেকে বিভিন্ন ভাবে ডাকা হয়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কর্মচারীদেরকে সাধারণ মানুষের সেবক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দেশের সংবিধানেও প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মকর্তাকে স্যার ডাকার বিধান রাখা হয়নি। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা হিসেবে আছেন তাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। 'স্যার' সম্বোধন না করলে অসহযোগিতা করা কিংবা জোর করে সম্বোধন আদায় করার কোন সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে ভুক্তভোগী হলে সেক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে যে ভূমিকা পালন করতে হয় সেটা আমরা অবশ্যই করবো।"


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: