শেষ হচ্ছে জাবি উপাচার্যের মেয়াদ : নতুন উপাচার্য নিয়ে নানা গুঞ্জন

মান্নান, জাবি প্রতিনিধি | ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ০৮:০১

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম টানা দুইবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এ বছরের ২ মার্চ শেষ হবে তার উপাচার্যের দায়িত্বের মেয়াদ। ফলে আগামী মেয়াদে কে হচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য তা নিয়ে ক্যম্পাস জুড়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা।

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের ১১.১ এর ধারা অনুযায়ী, আচার্য সিনেট কর্তৃক মনোনীত তিন ব্যক্তির একটি প্যানেল থেকে অধ্যাদেশের নির্ধারিত নিয়ম ও শর্তাবলী মেনে একজনকে চার বছরের জন্য উপাচার্য নিযুক্ত করবেন। আচার্য যোগ্য মনে করলে পূর্ববর্তী উপাচার্যকে সর্বোচ্চ চার বছরের জন্য পুনরায় দায়িত্ব দিতে পারেন। অধ্যাদেশের কোনো ধারাতেই কোন ব্যক্তিকে তৃতীয়বার উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের বিধান এবং ইতিহাসে এ ধরনের নজির নেই। ফলে আগামী ২ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হতে যাচ্ছে।

১৯৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের ২য় মেয়াদ সমাপ্তের পর উপাচার্য হিসেবে আর দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। তাই ক্যাম্পাসে কে হচ্ছেন পরবর্তী উপাচার্য তা নিয়ে চলছে আলোচনা। জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগরের ২০তম উপাচার্য হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। তারা সামরিক, রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন।

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মহল ও শিক্ষকদের সূত্রে জানা যায়, উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে নাম এসেছে আট প্রভাবশালী শিক্ষকের।

উপাচার্য হওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও সম্প্রতি উপ-উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্ব শেষ করা অধ্যাপক মো. আমির হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ'-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে তার বিরুদ্ধে ২০০৪-০৫ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় অনৈতিক উপায়ে নিজের আপন ভাগ্নেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অভিযোগ রয়েছে। উক্ত ঘটনার তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় প্রতিবেদনটি ২০০৬ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি স্ট্রাকচারড কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় উক্ত ছাত্রের ভর্তি বাতিল করা হয়। তবে এ ঘটনায় অধ্যাপক আমির হোসেনের কোন শাস্তি হয়নি বলে জানা যায়। এছাড়াও তিনি বামপন্থী ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি আওয়ামীপন্হী শিক্ষক রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে উপাচার্য হতে তিনি প্রভাবশালীদের দিয়ে লবিং করছেন বলে জানা গেছে।

উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক এম এ মতিন। তিনি বিভাগের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে জাবি শিক্ষক সমিতির সংবিধান প্রণয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি বিধি প্রণয়ন ও সিনেটের কার্যবিধি প্রণয়ণের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্নকরণ ও শিক্ষার্থীবান্ধব বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহন করেছিলেন অধ্যাপক মতিন। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।

সম্প্রতি উপ-উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্ব পাওয়া ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হকও উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আছেন। সমাজবিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা এ অধ্যাপকও উপাচার্য হতে চান। তবে তিনি শারিরীকভাবে অসুস্থ থাকেন ও প্রায় সময়ই অফিসে অনুপস্থিত থাকেন বলে জানা গেছে।

বর্তমানে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও পূর্বে বামপন্থী ও বিএনপিপন্হী রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে অধ্যাপক শেখ মো. মনজুুরুল হকের বিরুদ্ধে। একসময় তিনি আওয়ামীলীগ বিরোধী প্লাটফর্ম লেখক শিবিরের হয়ে কাজ করতেন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন পদে বিএনপিপন্হী শিক্ষকদের ব্যানারে সাদা দলের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিএনপিপন্থী উপাচার্য খন্দকার মোস্তাহিদুর রহমানের সময় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে জয়লাভও করেছিলেন অধ্যাপক মনজুরুল। সম্প্রতি তিনি প্রভাবশালী এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং ঐ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েই পুনরায় উপাচার্য হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা যায়।

উপাচার্য হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন গাণিতিক ও পদার্থবিজ্ঞানবিষয়ক অনুষদের ডিন ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার। তিনি নিজ স্বার্থে দল পরিবর্তনকারী হিসেবে শিক্ষক মহলে পরিচিত। বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় তিনি উপাচার্যবিরোধী আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলন করেন। তবে পরে ব্যক্তিস্বার্থে উপাচার্যের বলয়ে যোগ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অধ্যাপক অজিতের বারংবার দলবদলের কারণে সরকার ও প্রশাসন বেশ বিব্রত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও তিনি চরম গোত্রবাদ লালন করেন বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নুরুল আলম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার, জাবির সাবেক শিক্ষক ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) এর সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এম. আবুল কাশেম মজুমদার এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীর নামও সম্ভাব্য উপাচার্যের তালিকায় রয়েছে বলা জানা যায়।

উপাচার্য কেমন হবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, যিনি শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করবেন তিনিই উপাচার্য হবেন। কিন্তু আমাদের এখানে যারা উপাচার্য হন তারা শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করেন না বরং দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রচেষ্টা চালান। ফলে তার ওপর সবার অসন্তেুাষ সৃষ্টি হয়।

এর আগে তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এক মেয়াদের বেশি উপাচার্য থাকার দরকার নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তৃতীয় মেয়াদে থাকবে কি না, সেটা সরকার জানে। তবে তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার নিয়ম আমার জানা নেই।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য কে হবেন এটা নিয়ে আগ্রহ ও উত্তেজনা কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: